১।
আসফিয়া গাঢ় চোখে তার দিকে তাকিয়ে বললো, “আপনি বলছেন আ্মার এই রুম থেকে দুই লাখ টাকার সম্পত্তি চুরি করে নিয়ে যাবেন?“ সাংবাদিক মুহিব হাসিমুখে দিয়ে বললো, জি ম্যাডাম। আসফিয়া হেসে বললো, “মুহিব ভাই, আপনি সবসময় মজা করেন। আপনি কি জানেন? আর সব সাংবাদিক আসলেই আমি বিরক্ত হই আতঙ্কিত হই…আপনার ক্ষেত্রে হইনা। আর কাউকে কিন্তু আমি বাসাতেও আনিনা।“ মুহিব অনেকটা মাথা নুইয়ে বললো, “আমি ধন্য ম্যাডাম।“ তারপর বেশ স্পষ্ট ভাবে আসফিয়ার শাড়ির দিকে তাকিয়ে বললো, “আপনার শাড়িটা কিন্তু খুব সুন্দর। পুরোনো হলেও সুন্দর।“
আসফিয়া একটু বিষন্ন রকমের হাসি ঝুলিয়ে রাখলো ঠোঁটের কোণে। একটু অন্যমনা হয়ে গেলো মনে হয়। কোথাও হারিয়ে রইলো কিছুক্ষণ তারপর আবার ফিরে এলো। হেসে বললো, “কিন্তু এই রুমেতো তেমন দামী কিছুই নেই। আর আপনি যাই নেন সিসি ক্যামেরাতে সব ধরা পড়বে। হাহাহা। যাইহোক আমি ওয়াশ রুম থেকে একটু চেঞ্জ হয়ে আসি তারপর আমাদের প্রজেক্ট সম্বন্ধে আলাপ করবো। ” আসফিয়া নিজের ঘরের দিকে হাঁটলো। ততক্ষণে আসফিয়ার ছেলেটা এসে গল্প শুরু করে দিলো তার সাথে। কাজের মেয়েটি চা দিয়ে গেলো। আসফিয়ার হ্যাজবেন্ড ভদ্রলোক এসে দুই একটা কথাও বলে গেলেন।
আসফিয়া ফ্রেশ হয়ে আসার পরে বেশ কিছুক্ষণ প্রশ্ন আর উত্তর চললো। সাক্ষাৎকার শেষে মুহিব একবার বললো৷, বাথরুমে যাবে। কমন বাথরুমটা তাকে দেখালো আসফিয়া। মুহিব ঢুকে সাথে সাথে বের হয়ে বললো, ম্যাডাম এটাতে পানি নেই। আসফিয়া একটু বিরক্ত হলো। এমন হবার কথা নয়। সে বাধ্য হয়ে মুহিবকে তাদের পারসোনাল টয়লেটে ঢুকিয়ে দিলো।
মুহিব চলে যাবার পর আসফিয়া বেশ লম্বা ঘুমের আয়োজন করে ফেললো। অনেকটা দিন হলো তার শরীর ক্লান্ত, ঝামেলা নিতে পারছেনা। বিছানায় শুয়ে পড়া মাত্র সে ঘুমিয়ে গেলো। সেই ঘুম আর ভাঙ্গে কে! আসফিয়া ঘুমের মাঝেই বুঝলো তার আগের বুয়া এসেছে। কিছুক্ষন তার সাথে কথাও বললো, সে নিজেও কিছু কিছু উত্তর দিলো গভীর তন্দ্রার মাঝে। তার ছেলের দুইজন বন্ধু আসছিলো। ছেলের বাবার গেস্ট আসছে। ড্রয়িং রুমে বেশ হৈ হুল্লোড় শোনা গেলো। আসফিয়ার ঘুম তাতে ভেঙ্গে গেলোনা। তবে গভীর ঘুমের মাঝে একবার তার মনে হলো তার পাশে কেউ একজন দাঁড়িয়েছে। গাঢ় শ্বাস ফেললো কেউ, তারপর হেঁটে চলে গেলো, ওয়াশ রুম খোলার শব্দ হলো। এইটুকুই। আসফিয়ার এই নিদ্রা আর তন্দ্রার বেলা শেষ হলো একদমই সন্ধ্যা লাগার কালে। এক কাপ কফি নিয়ে বারান্দায় বসতেই তার ছেলে এসে বসলো পাশে। আসফিয়া নরম গলায় বললো, “আপনি বিকেলে কিছু খেয়েছেন?” ছেলেটা না সুচক মাথা দোলালো। আসফিয়া কফি হাতে উঠে গেলো। ছেলেটার জন্য নাস্তা কি করবে ভাবতে থাকলো। ঘরে এসে কাপড় গোছাতে গোছাতে হঠাৎ শাড়িটার কথা মনে পরে গেলো। ওয়াশ রুম থেকে শাড়িটা এনে গুছিয়ে রাখতে হবে। ওয়াশ রুমে গিয়ে শাড়ির আর দেখা পেলোনা সে। শাড়িটা নেই। নেই! নেই!! নেই!!!
কি আশ্চর্য! আসফিয়ার মাথা খারাপের মতো হয়ে গেলো। শাড়ি কোথায় যাবে? ঘন্টা ধরে সে তার স্বামী পুত্র মিলে শাড়ি খুঁজলো। দারোয়ান ডেকে সিসি ক্যামেরা দেখতে বলা হলো। শাড়িটা কেউ নিয়ে গেছে? বিশেষ করে যে লোকটা সে ঘুমিয়ে থাকা অবস্থায় খুব কাছ থেকে ঘুরে গেলো, সে কে? ড্রাইভার ভয়ে ভয়ে উত্তর দিলো সিসি ক্যামেরা গত সাত দিন হলো কাজে করেনা। আসফিয়া এবার বারান্দায় এসে কাঁদতে শুরু করলো নীরবে। বেশ কিছুক্ষন কাঁদলো, যতক্ষন না তার বাচ্চাটা বারান্দায় এসে দাঁড়ায়। ছেলেটা কাছে আসার আগেই চোখ মুছে ফেলেছে সে, তবু ছেলেটা ভারী গলায় বললো, মা কাঁদছিলে কেন? আমি তোমাকে এর চেয়েও দামী শাড়ি কিনে দেবো? আসফিয়া এতো দুঃখের মাঝেও হেসে দেয়। ছেলেটার চুলে হাত বুলিয়ে দিয়ে বলে, “অনেকটাকা দিয়েও এই শাড়িটা আর কেনা যাবেনা বাবা। এসব জিনিস কিনে নেওয়া যায় না। পৃথিবীর অনেক কিছুই আছে যা কোনভাবেই কিনে ফেলা যায়না। তুমি যত বড় হবে ততই বুঝবে।“
২।
সকাল সকাল মোবাইল রিং বাজছিলো। আসফিয়ার রাত জাগা চোখ কান কেবলই একটু শান্ত হয়ে আসছিলো কিন্তু ফোনের রিং সব এলোমেলো করে দিলো। আসফিয়া চোখ খুলে তাকালো আর সবার আগে শাড়িটা কথাও মনে হলো। একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে সে ফোনটা হাতে নিলো।
ফোন ধরতেই ওপাশ থেকে তার ড্রাইভারের গলা শোনা গেলো, “ম্যাডাম সাংবাদিক মুহিব, ঐযে মাঝে মাঝে বিখ্যাতদের জিনিস নিলামে তোলে, বিক্রি করে দান খয়রাত করে। উনি মনে হয় আপনার শাড়িটাও তুলেছে নিলামে। বলেছিলাম না খুব খারাপ লোক ম্যাডাম। শয়তান একটা। উনার ইউটিউব চ্যানেল খুলে দেখেন।“ আসফিয়ার মাথা কাজ করছিলোনা। সে কাঁপা গলায় তার স্বামীকে ডাকলো। তার স্বামী কাছে এসে ড্রাইভারের সাথে কথা বললো। ইউটিউব লাইভে “Muhib talks” খুলে নেয়। ঐতো তার শাড়িটা। হারিয়ে যাওয়া সন্তানের দেখা পাওয়াও কি এতো আনন্দের হয়। আসফিয়ার বুক জ্বলে উঠলো। কে যেন ১০ হাজার টাকা বলে শাড়িতে হাত দিয়েছে। আসফিয়া অন লাইনে যুক্ত হলো চিৎকার করে বললো, ৫০ হাজার। আমি এটা ৫০ হাজার টাকা দিয়ে নেবো।
-ষাট হাজার।
-আশি হাজার
-১ লাখ
-দেড় লাখ
-এক লাখ সত্তর।
-দুই লাখ। দুই লাখ টাকা।
আসফিয়া গলাতে সমস্ত জোর লাগিয়ে চিৎকার করে উঠলো, “এটাতে কেউ হাত দিবেনা । কেউনা। আমি পুরো দুইলাখ টাকা দেবো। এই শাড়িই আমার লাগবে। এটা আমার মায়ের বিয়ের শাড়ি ।এ টা আমার… “
৩।
আসফিয়ার ড্রয়িং রুমে মুহিব চুপচাপ বসে আছে।মুহিব বললো, ম্যাডাম আমি টাকা নিতে আসিনি। নেবোওনা। আমি আসলে একটা মজা…
-এটা মজা নয় মুহিব ভাই। আমি সারারাত ঘুমাতে পারিনি শাড়িটার চিন্তায়। সকালে যখন নিলামে উঠেছে দেখলাম…
-আর মাথা ঠিক রাখতে পারেননি , তাইনা? দেখেন এই শাড়ির ছবিটাই আগের দিনই আপনি ফেসবুকে দিয়েছেন। আপনার হাতে খুব শক্তিশালী প্রমাণ ছিলো। আপনি চাইলে পুলিশেও খবর দিতে পারতেন।
-আমার মাথা ঠিক ছিলোনা। মনে হচ্ছিলো, কেউ আমার হৃদয়ের অর্ধেকটা কোথাও নিয়ে বিক্রি করে দিচ্ছে…
-আবার দেখেন এই শাড়ি আপনার কাছে মহা মূল্যবান। অন্যদের কাছে তো আর নয়। ৪৫ বছর আগের শাড়ী ২ হাজার টাকাতেও বিক্রি হবেনা। কিন্তু আমার সাজানো নাটক অনুযায়ী অন্যরা নিলামে ডাক দিয়ে যাচ্ছিলো …আপনিও বুঝতে পারেননি…
আসফিয়া দীর্ঘশ্বাস ফেলে। “আপনি বুঝবেননা মুহিব ভাই একটা মেয়ের কাছে তার মায়ের বিয়ের শাড়ি কি জিনিস।“
তারপর সোফার আরেকপাশে বসে বললো, আপনি কেন এসব করলেন?
-দু’টো কারণে। এক আমি শুধু চাচ্ছিলাম ডাকটা দুই লাখে পৌঁছুক, তখন আপনাকে বলতে পারবো , এইতো দুই লাখ টাকার জিনিস ঠিকই চুরি করেছিলাম। ।
সারাদিন পর এই মাত্র আসফিয়ার মুখ স্বাভাবিক দেখা গেলো কিছুটা।
-আপনি এতো কাহিনী কি করে ঘটালেন । বলেনতো?
-হাহাহা। আপনি যখনই ফ্রেস হতে গেলেন , আমি শুধু দেখলাম আপনি শাড়ি পরেই ঘরে ঢুকলেন। তারপর ওয়াশ রুম। তারপর বেশ কিছু পরে সালোয়ার কামিজ পরে ফিরলেন। আমি তো এসেইছি শাড়িটা নিয়ে যেতে তাও লুকিয়ে। সুতরাং আমি খুব আশা করে থাকলাম আপনি শাড়িটা বাথরুমেই কোন লকারে রেখে দিয়েছেন। এরপর আমি যা করলাম তা হলো, ওয়াশ রুমে যাবার কথা বললাম। একটা স্বাভাবিক পানি পড়া ওয়াশ রুমে ঢুকে বললাম, পানি নেই । আপনি আমাকে একদম কাঙ্খিত জায়গায় নিয়ে গেলেন। গিয়েই দেখি শাড়িটা ঝুলছে। আপনি একবারো ভাবলেন না এই সাংবাদিক কেন নিজের সবচেয়ে প্রিয় জিনিস ক্যামেরা নিয়ে বাথরুমে যাচ্ছে? জীবনে কখনো কোন সাংবাদিককে দেখেছেন ক্যামেরার বড় বাক্স সহ বাথরুমে ঢুকতে। আমি আসলে শাড়িটা সেখানেই লুকাতে নিয়েছিলাম। ম্যাডাম আপনি আসলেও অনেক সরল।
আসফিয়া এবার তীক্ষ্ণ চোখে তাকিয়ে বললো, এবার দ্বিতীয় কারণ শুনি? মুহিব ব্যাগ থেকে একটা প্যাকেট বের করলো। তারপর একটা ছবি। আসফিয়ার হাতে তুলে দিলো। আসফিয়া ছবিটি হাতে অনেকক্ষণ হা হয়ে তাকিয়ে রইলো। হঠাৎ চোখের কোণে জল চলে আসলো। মুহিবের দিকে তাকালো।
-এটাই দ্বিতীয় এবং প্রধান কারণ। ম্যাডাম আমার মায়ের কোন ছবি আমার কাছে নেই। মা দেখতে কেমন তাও মনে পড়েনা। বিয়ের দিনের কথাতো আলাদা। কিন্তু কাল আপনার মায়ের শাড়ি পড়ার ছবিটা দেখার পর মনে হলো, খালাম্মার ছবিও তো আমি দেখেছি। আপনার ফেসবুক অ্যাকাউন্টেই আছে। সুতরাং দীর্ঘদিন আর্টিফিসিয়াল ইন্টেলিজেন্সি নিয়ে কাজ করার সকল অভিজ্ঞতা কাজে লাগিয়ে এটা বানিয়ে ফেললাম।
-ঠিক মনে হচ্ছে আমার মার বিয়ের দিন। মার বিয়ের দিনের ছবি একটা দুইটা আছে, কিন্তু এমন ময়লা আর সাদাকালো ছবি…
-তবে আমার মনে হয়েছিলো শাড়িটাকে আরেকটু ভালো করে না দেখলে হবেনা, আবার ঐদিকে আপনাকে সারপ্রাইজও দিতে চাইলাম…তাই এতো কিছু…আপনি আমাকে এখন ক্ষমা করেছেন আশা করি…তাহলে উঠতে পারি…
আসফিয়া রাগী গলায় বলে, উঠলেতো হবেনা। চা খাবেন , তারপর যাবেন। তবে বাথরুমের যেতে পারবেননা। এই বাসার বাথরুম আপনার জন্য বন্ধ। চিরদিনের জন্য বন্ধ।
কি লিখেছেন কিছুই বুঝলাম না! সবসময় ভালো লেখেন দু’একটা খারাপ হতেই পারে, তাতে দোষের কিছু না।
ধন্যবাদ কমেন্টের জন্য। চেষ্টা করবো। ভালো থাকবেন।