“সেলামি”

১।
ত্রপা আমার দিকে হাত এগিয়ে দিয়ে বলল, “ফাগুন ভাই আপনি না এতো সুন্দর ছবি আকেন? একটু সুন্দর করে মেহেদি লাগিয়ে দেন।” আমি বিব্রত হয়ে বললাম, “ছবি আকা আর মেহেদি লাগানো তো এক নয়।” সে আহ্লাদ করে উঠল, “আমি জানি না, আপনি আকিয়ে নিবেন আগে,পরে মেহেদি লাগিয়ে দিবেন।” সে তার শুভ্র নরম একগুচ্ছ বেলি ফুলের মতো কোমল হাত এগিয়ে দিল আমার দিকে। সেই হাতের আমন্ত্রণ গ্রহন না করলে পৌরাণিক পাপ হয়ে যায়, মানবজন্ম অর্থহীন হয়ে যায়, সকালের প্রথম আলো ফিরে যায় ঘরে, রাত আর দিন হয় না। আমি আলতো করে একবার হাত ধরলাম। তারপর বললাম, “কাল ঈদ, আর আজ তুমি আমাকে কি একটা ঝামেলায় ফেললে বলত।” ত্রপা গাঢ় গলায় বলল, “এই যে আপনি আমার হাতে মেহেদি দিচ্ছেন, চিরদিন এই কথা মনে থাকবে।” আমি আকতে শুরু করলাম। মেহেদিও দিয়ে দিলাম, আমার মনে হলো মেহেদি না শুকিয়ে যাওয়া পর্যন্ত হাত ধরে থাকার ব্যাপার থাকলে কি আনন্দই না হতো।

ঈদের দিন নামাজ থেকে ফিরে বাবা বলল, যাবি ত্রপাদের বাসায়? আমি এমনি হলে যেতাম না কিন্তু কালকের বেলীগুচ্ছের আহবানের মতোই কেউ যেন আমার হৃদয় ধরে টান দিয়ে বলল, “যাও। ত্রপা অপেক্ষায় আছে।” ত্রপার হাতের মেহেদি কি দারুণ লেগে গেছে। আমি একটা চাদকে নৌকার মতো ভাসিয়ে আশে পাশে অনেক গুলো হৃদ-চিহ্ন আকতে চেয়েছিলাম। হয়েছে কতটা জানি না কিন্তু ত্রপার শুভ্র হাতে সেই মেহেদির দাগ স্নিগ্ধতাই জ্বলে উঠেছে। ত্রপা আমাকে বলল, “আমার সেলামি কই?” আমি বললাম, “এমন যোগ্য সেলামি আমি কি করে দেই এখনি? সামনের ঈদে নিশ্চয় দেবো…”

২।
পরের ঈদে সকাল সকাল ত্রপাদের বাসায় গিয়েছি। একটু অস্বস্তিও লাগছে। এবার আর বাবা আসেনি। ত্রপারা আমাদের ঠিক আত্বীয় হয় এমনো নয়। তবে যাওয়া আসা অনেক আগে থেকে। খালাম্মা একগাদা খাবার খেতে দিয়েছেন এর মাঝে ত্রপা এসে বলল, “ফাগুনদা আপনি না এবার আমাকে সেলামি দিবেন?” আমি পায়েস মুখে দিয়ে বললাম, “এনেছি তো। এই নাও।“
প্রায় এক সপ্তাহ ধরে আমি একেছি এই ছবিটা। জলরঙ দিয়ে আকা। একটা নীল সালোয়ার পরা তরুণী হাত বাড়িয়ে রেখেছে , আর হাতে একটু এলেমেলো চুল আর চেহারার তরুন একমনে মেহেদি দিচ্ছে। মেয়েটের লম্বা চুলের একটা অংশ বাতাসে ছেলেটির মাথাকে স্পর্শ করে আছে। মেয়েটির চোখ জুড়ে মুগ্ধতা আর ছেলেটির একাগ্রতা। ত্রপা অনেকক্ষন সেই ছবির দিকে তাকিয়ে রইলো, তারপর চোখ ভর্তি জল নিয়ে বলল, “কি করে এতো সুন্দর আকলে তুমি? এই ছবির কি দাম দিবো আমি?”
-দাম তো দিয়েই ফেলেছ।
-মানে?
-এই যে চোখ ভরা জল। আর “তুমি”তে নেমে আসলে হঠাৎ…
-ওহ দেখেছ! এতো অবাক হয়েছি যে, তুমি বলে ফেলেছি…
-আমি কিন্তু এটাকে আমার পুরস্কারই মনে করেছি…

৩।
ঈদ ছাড়া আমার আসলে গ্রামে যাওয়া হয় না। ত্রপার সাথেও দেখা হয় না। অথচ সারা দিন কতবার তাকে ভাবি। একটা কেমন বিরহ রকমের অনুভূতি টের পাই নিজের মাঝে। তবে গ্রামে আসলে ত্রপাকে খুব ইচ্ছে হয় দেখতে। দেখা পেলামও। এবার অবশ্য আমার তার বাসায় যেতে হলোনা। ত্রপা নিজেই ঈদের আগের রাতে আমার বাসায় এসে উপস্থিত। মাকে জড়িয়ে ধরে বলল, “ফাগুনদা এতো সুন্দর করে একে মেহেদি লাগিয়ে দেয় জানো খালা? বলোনা একে দিতে…” মা আমার ঘরে ঢুকে বেশ জোরালো গলায় বলল, “এই আমার মেয়েটাকে সবচেয়ে সুন্দর করে মেহেদি আকিয়ে দিবি।”
ত্রপার হাত ধরে বসে আছি কি যে আকবো এবার ভাবছি। সে এদিক সেদিক তাকিয়ে আমার আকা ছবি দেখছে।
-আচ্ছা ফাগুনদা তোমার এমন কোন কিছু আছে যা আকতে ইচ্ছে করে? আকা হয়নি?
-আছে তো। থাকবে না?
-কোন ছবি?
-অনেক গুলো ছবিই আছে লিস্টে… তবে এই মুহুর্তে একটা ছবির কথা খুব মনে করছে…
-কোনটা?
-ঐযে জ্যাক যেটা এঁকেছিল…
-মানে?
-মানে জ্যাক রোজের একটা ছবি এঁকেছিল না? টাইটানিকে বসে…

মনে হলো ত্রপার হাতটা একটু খানি কেপে উঠল। মুখ দিয়ে হঠাৎ “ছি” এর মতো কিছু শব্দ বের হয়ে গেলো। তারপর একটু স্থির হয়ে জিজ্ঞেস করলো- “কে তোমাকে দিবে এমন ছবি আকতে?” আমি ত্রপার হাতের দিকে ব্যস্ত থেকেই বলে বসলাম, “তুমি দিলেও হয়। তুমি কি কেটের চেয়ে কম সুন্দরী?” আমি ভেবেছিলাম এবার ত্রপা হয়তো হাতটা টান দিবে অথবা জোরে ধমক দিবে অথবা শান্ত গলায় একটু বকা দিবে। সেইসব কিছুই হলো না। আমার উলটো মনে হলো সে তার হাতকে আরেকটু বেশি আন্তরিক করে মেলে দিয়েছে। অনেকক্ষন পর শুনলাম সে বলল, “কিন্তু আমি তো জ্যাককে মরতে দেবো না। এতো সহজ বলো…”

৪।
পরপর দুই বছর আর গ্রামে যাওয়া হলো না। একবার এক্সিবিশনে ইটালী গেলাম। পরেরবার নানা রকম যন্ত্রণায় যেতে পারলাম না। এবার বাসায় এসেই শুনি, ত্রপার নাকি বিয়ে। সেই বিয়ে আবার আমার বাবাই ঠিক করেছে। বাবা আমাকে উচ্ছাস নিয়ে বললেন, “জানিস এতো ভালো ছেলে একটা যোগাড় করেছি। মনে হয় সোনার ছেলে। দেখলেই বুঝবি।” আমি বিড়বিড় করে বললাম, “ছেলের প্রেমের এমন গুরতর ব্যাঘাত দেবদাসের বাবাও করতে পারেনি।”
বাবার চাপে পড়েই ঈদের নামাজের পরেই বাবার সাথেই ত্রপাদের বাসায় চলে গেলাম। সবাই মিলে ত্রপার বিয়ের আলোচনা করছে। আমার মনে হলো ফাসির আসামী্র সামনে ফাসির মঞ্চের গল্প তুললে বোধ হয় এমনি লাগে। খালাম্মা জর্দা প্লেটে তুলে দিতে দিতে বলল, “দেখ, এবার তোর মায়ের চেয়ে ভালো জর্দা রেধেছি, খেয়ে দেখ।” আমিও হেসে বললাম, “হতেই হবে। আমার মায়ের বাসায়তো আর জামাই আসছে না সামনে। তাই না?”
সবাইকে হাসি মুখে রেখেই আমি ত্রপাকে খুজতে লাগলাম। ত্রপা নিজের রুমে চুপচাপ বসে ছিলো। আমাকে দেখে হাসি মুখে বলল,
-আমার তো বিয়ে হয়ে যাচ্ছে, এখন তোমার রোজ কে হবে বলত?
আমি কোন উত্তর পাচ্ছিলাম না অথবা দিতেও চাচ্ছিলাম না। গলার কাছে অকারণে কিছু একটা আটকে রয়েছে মনে হয়।
-তুমি বেশি শুকিয়ে গেছো ফাগুনদা।
-তা হয়েছি বটে কিছুটা।
কিছুক্ষন ত্রপা কিছু বললনা। আমি খুজে পেলামনা বলার মতো কিছু।
-ফাগুনদা তুমি বিয়ে করবেনা? শিল্পীদের বিয়ে করতে হয় না?
-হবেনা কেন? করবো তো!
-ঘোড়ার ডিম করবে।
রাগী চোখে তাকিয়ে ছিলো সে। কথায় রাগ ছিলো, যন্ত্রণাও ছিলো। কিছুক্ষন আবার কেউ কিছু বললাম না, ত্রপাই মুখ খুলল রাগ কমে গেলে…
-আমাকে এতো অবহেলা কেন করলে? কেন?
-না না। আমি শুধু আমাকেই অবহেলা করেছি। আর কাউকেই নয়।
-তোমার সাথে যোগাযোগের কোন উপায় নেই। মোবাইল ব্যবহার কর না।
-হুম। শিল্পীদের এত ঠিকানা থাকতে নেই।
-একটা মাত্র হলের নাম্বার যতবার ফোন দেই তুমি থাকো না। যে ফোন ধরে সেও তোমাকে চেনে না।
-বললাম না, ঠিকানা থাকতে নেই।
ত্রপা গাঢ় ভাবে আমার দ্বিকে তাকালো। আমি চোখ নামিয়ে রইলাম। ত্রপা স্নিগ্ধ গলায় বলল,
-তুমি কি হাত বাড়িয়ে বেদনা কে সাথে নিলে? কতটুকু বেদনা হৃদয়ে জমলে তোমার রঙ পেন্সিল বেশি কাজ দিবে?
-ত্রপা ছবি আকা ছাড়া আমি কিছু জানি না। কতদিন যায় আমার পাউরুটি চাবিয়ে দিন চলে যায়। তোমাকে কেন কষ্ট দিবো?
অনেকক্ষন কথা হয় না। আমিও আর কথা বলবোনা ভেবেই থাকি। ত্রপার দিকে তাকাতেও ইচ্ছে হয় না। অনেকটা জলে ডুবে থাকা কন্ঠের মতো গলা সাজিয়ে ত্রপা বলে,
-তোমাকে আমার এমনই স্বার্থপর মনে হয়। কাটাইলাম না হয় অর্ধাহারে অনাহারে তবুও তো পাশে বসে দেখতে পারতাম পৃথিবীর এতো সব রঙের এতো খেলা এতো যাদু…
-সেসব মনে হয় ত্রপা। তুমি বুঝবে না।
ত্রপা হাল্কা করে হাসে। তারপর বলে,
-মাথা নীচু করে আছ কেন? তাকাও আমার দিকে…পাশে বসো…
আমি তাকালাম তার দিকে। ঝর্ণাতে পানির প্রবাহ বন্ধ হয়ে গেলেও যেমন পানির দাগ বেশ বোঝা যায় তেমনি একটা কালচে ছায়া যেন ত্রপার গাল বেয়ে। ঠিক এমন একটা ছবি আকতে পারলে বেশ হতো। আমার হঠাৎ মনে হলো আমার ঢাকা ফিরে যাওয়া উচিৎ ছবিটা আকার জন্য। ছবির নামও ঠিক করে ফেললাম। “জল ছায়া”। ছবি থাকবে তাতে জল থাকবেনা, অথচ নাম হবে “জল ছায়া”। ত্রপা আমার কাছে এসে বলল, আবার হারিয়ে গেছ, হারাও। সমস্যা কি? আমার তো আর হারানোর ভয় নেই।
-থাকো ত্রপা। আমি যাচ্ছি।
-দেখো তোমার ছবি একদিন লাখ লাখ টাকায় বিক্রি হবে। তুমি সেরা শিল্পী হবে দেখো। ফাগুনদা, চলে যাচ্ছো কেন। আমার সেলামি দিবেনা?
আমি বললাম, “নিয়ে যাও। মনে করো আমার হৃদয়টাকেই দিলাম তোমার কাছে।“ ত্রপা অনেক জোরে হেসে দিলো। তারপর বলল,
-শিল্পীর হৃদয় নিয়ে আমি কি করবো বলো? সেটা কারোর একার সম্পত্তি হবার নয়। তাই না?

ত্রপাদের বাসা থেকে একা একাই আমি পথে নেমে এসেছি। ঈদ ততক্ষনে জমে গেছে। ছোট বাচ্চারা লাল- নীল- সবুজ পাঞ্জাবী-সালোয়ার কামিজ-প্যান্ট শার্ট পরে নেমে গেছে পথে। বাচ্চাদের লাইন ধরে হাটা দেখতে দারুণ লাগছে। মজিদের দোকানে তখন হাল্কা সাউন্ডে হিন্দি গান বাজছে। বেশ কিছু অল্প বয়সী মানুষ সিগারেট টানছে। এই বিরাট জনতার ঢেউ এর মাঝে দাঁড়িয়ে একবার আমার মনে হলো, আমি একটা ভুল করলাম, বড় রকমের ভুল। আমার কান্না আসছিল বেশ। আমি কাঁদলাম। খোলা সূর্যের নীচে দাঁড়িয়ে। কয়েক ফোটা জল ঝরুক। জলের ও তো দাবী থাকে কিছু।

৫।
ত্রপার কাছ থেকে বেশ কিছু যন্ত্রণা আমি পেয়েছি। এটাকে বিরহ বলে কিনা জানি না। তবে আমার মনে হয়েছে ছবি আকতে গিয়ে কোথাও একটা যন্ত্রণা কাজ করে, বারবার একটা হাতের কথা মনে হয়, ছবি আকতে গিয়ে আমার মাঝে মাঝেই মনে হয়, ছবি নয়। কোন ক্যানভাস নেই। একটা কোমল হাত আমি ধরে রেখেছি তাতে পেন্সিল দিয়ে দাগ আকতে হবে এরপর মেহেদি লাগিয়ে দেবো।
আমি প্রতিদিন তাই মেহেদি লাগিয়ে যাই। কোন কোন প্রদর্শনীতে প্রশংসিত হয়, পুরস্কার ও পাই আমি। আমার প্রায়ই মনে হয় ত্রপার কাছে পাওয়া বেদনা আমার দরকার ছিলো। বেশ দরকার ছিলো।

ঈদ নিয়ে আমার আরেকটি গল্প পড়ুনঃ ঈদের চতুর্দিক

আমার অন্য লেখা পড়ুন

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here

Reviews

Popular Articles