ঈদের চতুর্দিক

ঈদের দিন উপলক্ষ্যে মায়মুন মায়ের কাছে একটা কাপড় চায়। একটা মাত্র ছেড়া কাপড় তার। জয়গুন ধাক্কা দিয়ে মায়মুনকে সরিয়ে দিয়ে ভেংচিয়ে বলে, “হ! কাপোড়! কাপোড় দিয়া কবর দিমু তোরে শয়তান”। এরপর মেয়েকে ছেলের গামছা দিয়ে আব্রুত করে জয়গুন তার মেয়ের ছেড়া জামা সেলাই করতে থাকে। তার ছেলে হাসুও একটা টুপি চায়। খালি মাথায় নামাজে কি করে যায়! কিন্তু মায়মুন তা দিতেও অপারগ। হাসুকে টুপি না দিয়ে সে একটা নতুন টুপি দিতে চায় তার আগের স্বামীর ঘরের ছেলে কাসুকে। ঈদের সকালে তাদের ঘরে রান্না হয় তিন পোয়া চাউল আর এক পোয়া গুড়ের সাথে কিছু মাত্র চিনি আর নারিকেল দিয়ে বানানো শিন্নি। সেই শিন্নিও অপর্যাপ্ত। শেষের দিকে সেই শিন্নির প্লেটে মায়মুন এমন ভাবে চেটে খেতে লাগলো যে তার মা চেচিয়ে বলে উঠলো, “অহন আত ধো। তুই দ্যাখতে আছি বাসনডা ভাইঙা খাইতে চাস।”

কি একটা বিষন্নতা ভরা উপন্যাস “সূর্য-দীঘল বাড়ী”। দারিদ্রতার কি চরম বহিঃপ্রকাশ। প্রতিটা অক্ষরে অক্ষরে যেন বঞ্চিতদের কথা, অবহেলিতদের গল্প। তবুও শেষ পর্যন্ত তা জীবনেরই গল্প।

আমি আমাদের সাহিত্যে ঈদের দিন খুজতে গিয়ে “সূর্য-দীঘল বাড়ী”র কথায় সবার আগে মনে করলাম। এই লাইন গুলো প্রতিটি ঈদে আমার মনে হয়। আমার চারপাশে ঘুরে বেড়ায় মায়মুন নামের সেই অভিমানী চেহারার বাচ্চা মেয়েটি, পুরানো টুপি মাথায় দিয়ে ঈদগা যাওয়া হাসু/কাসু বা ব্যক্তিত্বে অনন্য জয়গুন আর তাদের দারিদ্র ক্লিষ্ট ঈদ।

আখতারুজ্জামান ইলিয়াসের আছে ছোটগল্প “ঈদ”। রজবের ঈদ। ঈদের সকালে তাড়াহুড়ো করে মায়ের সাথে তার মনিবের বাসায় যায় রজব। মনিবের স্ত্রীর কাছে অনেক আকুতি মিনতি করে একটা বোতাম ছাড়া ছিন্নভিন্ন শার্ট এনে দেয় তাকে মা। কিন্তু সকালের প্রথম অংশেই কিছুটা সেমাই খেতে দেবার কারনে অপমান হতে হয় রজব আর রজবের মাকে। পরে সে বাসার অভিজাত ছেলেদের সাথে একটা গন্ডগোল বাধানোর ফলে মার খেতে হয় রজবকে। তার মা এসেও মেরে যায়। বাসায় ফিরে সারাটা ঈদ কেঁদে পার করে সে। রজবের মাও অনেক রাতে ফিরে এসে তার পাশে শুয়ে একটানা কাঁদতে থাকে আর তার মাঝেই থানার বড় ঘড়িটাতে রাত বারটার বেল শোনা যায়। রজবের মনে হলো, ভালোই হলো, তার ঈদ দরকার নেই, তার মায়েরও।

আমাদের দেশ কি সেই মায়মুন, হাসু বা রজবের ঈদের সময় অতিক্রম করে গেছে? প্রতিটা ঈদের জামাতে আমি মানুষ দেখি, গরিব মানুষের ছেলে মেয়েদের দেখি, তাদের গায়ে নতুন জামা আছে কী! সবার মাথায় টুপি আছে কি? যে মানুষ গুলো নিজেদের বাসার ঈদ রেখে বাসায় বাসায় কাজ করে যায় তারা আমাদের সাথে খেয়েছি কি? তাদের বাচ্চারা কি ক্ষুধা নিয়ে পরে আছে?

আমাদের গদ্য সাহিত্যে ঈদ হয়তো আরো এসেছে, আমার আর পড়াশোনা কতটুকুই বা। ঈদ নিয়ে কবিতা আছে অনেক এবং নজরুল ইসলামের কবিতাই এখানেও বেশি। আর যথার্থ কারনেই গরিবের ঈদই তাতে বেশি উপস্থিত। দুই একটা উদাহরন দেওয়াই যায়ঃ

প্রজারাই রোজ রোজা রাখিয়াছে আজীবন উপবাসী,
তাহাদেরই তরে এই রহমত, ঈদের চাঁদের হাসি। [কবিতাঃ ঈদের চাঁদ]

অথবা-
সবাই খোরাক পাইবে ক্ষুধার আসিবে ঈদের খুশি,
লুট করে নে রে আল্লার দান কেউ হবি না রে দুষী। [সর্বহারা]

জীবনে যাদের হররোজ রোজা ক্ষুধায় আসে না নিদ
মুমূর্ষু সেই কৃষকের ঘরে এসেছে কি আজ ঈদ? [কৃষকের ঈদ]

আর নজরুলের গান ছাড়া নিশ্চয় আমাদের রোজার ঈদ অসম্পুর্ণই থেকে যায়ঃ
ও মন রমজানের ঐ রোজার শেষে এলো খুশির ঈদ।
তুই আপনাকে আজ বিলিয়ে দে শোন আসমানী তাকিদ।।
তোর সোনাদানা বালাখানা সব রাহে লিল্লাহ।
দে জাকাত মুর্দা মুসলিমের আজ ভাঙাইতে নিদ।।

তবে ঈদ নিয়ে গান তৈরীর কাজ এখনো চলছেই, প্রতি ঈদেই আমরা নতুন নতুন গান শুনি ঈদ কেন্দ্রিক। কিন্তু আমাদের ততক্ষন ঈদ মনে হয়না যতক্ষন না জাতীয় কবির এই গানটি শুনি। ঈদ নিয়ে প্রচুর প্রবন্ধ লেখা হয় প্রতিবার, ঈদের স্মৃতি নিয়ে লেখেন বিশিষ্ট জনেরা, ঈদের তুলনা চলে এসময় আর সেইসময়ের মাঝের।

বিভিন্ন সময়ের ঈদকে খুজতে গিয়ে আমরা দেখি মোঘল আমল আর নবাবদের সময়ের ঈদকেই বারবার লেখাতে এনেছেন গবেষক লেখকেরা। মোঘল আমলের ঈদের খোজ দিতে লেখক সাদ উর রহমান আর আলী ইমাম উভয়েই মির্জা নাথানের বইয়ের রেফারেন্স নিয়েছেন। মির্জা নাথান যখন সুবেদার ইসলাম খানের (বাংলার গভর্নর ১৬০৮-১৬১৩) আমলের ঈদকে নিয়ে লিখেন তখন তিনি নিজে ময়মনসিংহ এলাকায় ছিলেন। সুতরাং এটুকু ধরে নেওয়া যায় তার এই ঈদের বর্ননা আমাদের ঢাকা কেন্দ্রিক। মির্জা নাথানের লেখা অনুযায়ী, সেই সময়ে রোজার শেষে চাঁদ দেখা যাওয়া মাত্র রাজকীয় ন্যাকরা আর আতশ বাজী শুরু হয়। দীর্ঘসময় ধরে বন্দুক থেকে গুলি নিক্ষেপ করা হয় আর রাত্রের শেষ ভাগে বড় কামান থেকে গোলা নিক্ষেপ করা। মির্জা নাথান একে রীতিমতো “ভুমিকম্প” বলে অ্যাখ্যা দিয়েছেন। মোঘল আমলের ঈদ নিয়ে “নওবাহার-ই-মুর্শিদকুলী খান” গ্রন্থের আজাদ হোসেন সেই সময়ের ঈদের যে বর্ণনা দিয়েছেন, তা যেন এখনো একইরকম আছে। ঈদ্গাহ আর মানুষের নতুন জামা আর গরিবদের টাকা পয়সা বিলিয়ে দেওয়ার ব্যাপার গুলো আগের মতোই আছে এখনো। লেখক আলী ইমাম ঈদের দিনের মোঘলদের খাবারের কিছু বর্ননা দিয়েছেন। একটা বর্ণনা রীতিমতো চাঞ্চল্যকর। ঈদের আগে আগেই কাশ্মির থেকে দুর্লভ জাফরান নিয়ে আসা হতো, এবং ঈদ উপলক্ষে বাছাই করা গরুগুলোকে খাবারের সাথে জাফরান মিশিয়ে দেওয়া হতো, তাতে রান্না মাংসে অপুর্ব সুন্দর ঘ্রান হতো। ব্যাপারটি অত্যন্ত ব্যয়বহুল। যেহেতু জাফরান সবচেয়ে ব্যয়বহুল আর অভিজাত মশলা ছিলো।

ঢাকার সবচেয়ে পুরানো ঈদগাহ তৈরী হয় সম্রাট শাহজাহানের পুত্র শাহসুজার সময়ে (১৬৪০ সাল)। শাহ সুজার প্রধান অমাত্য মীর কাসেম ধানমন্ডির এই প্রধান ঈদ গাহ তৈরী করেন। যদিও মুনতাসীর মামুন তার ঢাকা সমগ্রতে সন্দেহ প্রকাশ করে লিখেছেন, “মোঘল আমলে ঈদের দিন ঈদ গাহে যেত মোঘলরাই, সাধারণ মানুষের সেখানে জায়গা হতো কিনা সন্দেহ।” লেখক সাদ উর রহমান আর আলী ইমাম অবশ্য সেই সন্দেহকে অনেকটাই অস্বীকার করেছেন। ঢাকার নায়েব নাজিমদের বিদায়ের পর অবশ্য ঈদ উদযাপনে জাকজমকের ভাটা পড়ে। এর একটা বড় কারন হলো, অর্থনৈতিক ভাবে মুসলমানদের পিছিয়ে যাওয়া। আবার নবাবদের আমলে এসে আমরা ঈদ নিয়ে বেশ হৈ-হুল্লোড় দেখি। তারা শহরে ঢোল পিটিয়ে এবং কামানের তোপধ্বনির সাথে ঈদের ঘোষনা দিতেন। সেইসময়ের ঈদের আগে আগে দুইটি সম্প্রদায়ের মানুষের আনাগোনা বেড়ে যেত শহরে। প্রথমত নাপিত আর দ্বিতীয়টি হলো চুড়িওয়ালা। ঢাকার বিভিন্ন বাসায় ঈদের আগে আগে বা চান রাতে গান গাইতে গাইতে চুড়িওয়ালারা মেয়েদেরকে চুড়ি পরাতেন, বিক্রি করতেন। এই সময়ে ঈদ তিনদিন পর্যন্ত পালন করা হতো। ঈদের পর পরই নানা রকমের মেলা, কাবুলিওয়ালাদের নাচ, বাজপাখীর লড়াই এইরকমের নানা রকমের বিনোদন ছিলো মানুষদের আনন্দিত করার জন্য। তবে ঢাকার ঈদ উৎসবের একটা বড় মাধ্যম ছিলো ঈদ মিছিল। মোঘল সম্রাটদের বিক্রম প্রকাশের অন্যতম অনুসঙ্গ ছিলো ঈদ মিছিল। নানা রঙ্গে আর আনন্দের জৌলুসে আলোকিত ছিল ঈদের রাজকীয় মিছিল। নবাব-নায়েব গণ হাতির সামনের দিকে বসে মিছিলে সামিল হতেন। কৃত্রিম মুক্তো আর রুপোর তারের অলঙ্কর যুক্ত আনুষ্ঠানিক ছাতা থাকত। সাথে ছিলো ঘোড়া, উট। লাল, নীল, সবুজ, হলুদ সিল্কের ঝলমলে শত শত নিশান উড়ত মিছিলের সাথে। সাধারণ মানুষ পথের দুইধারে দাঁড়িয়ে এই মিছিল দেখত, বিস্মিত হতো। চকবাজার থেকে শুরু করে ইসলামপুর-পাটুয়াখালি-নবাবপুর-বাংশাল হয়ে আবারো চকবাজারে পৌছাইতো ঈদ মিছিল। কখনো কখনো এর ব্যতিক্রমও হতো। কিন্তু এই আনন্দের মিছিল একসময় সাম্প্রদায়িক দাঙ্গার একটা উছিলা হয়ে ওঠে। নবাবপুর দিয়ে অতিক্রম করার সময় স্থানীয়রা ঈদ মিছিলে নানা ভাবে বাধা দিতেন এবং সহিংসতা ছড়াতেন। বাধ্য হয়ে ১৯৫৪ সালে ঢাকা জেলা ম্যাজিস্ট্রেট ঈদ মিছিল বন্ধ ঘোষনা করেন। তবে দীর্ঘ ৪২ বছর পর ১৯৯৪ এ ঈদ মিছিল আবার দেখা যায় ঢাকাতে। ঢাকার ওয়ার্ড কমিশনার নাজির হোসেনের তত্ত্বাবধানে এই ঈদ মিছিলের মাঝে অবশ্য আরেকটা শব্দ যুক্ত হয় “আনন্দ”। শেষ পর্যন্ত “ঈদ আনন্দ মিছিল” নামেই মিছিলটি আবারো যাত্রা শুরু করে। তৎকালীন মেয়র হানিফ “ঈদ আনন্দ মিছিল” উদ্বোধন করেন। বিশিষ্ট জনদের উপস্থিতিতে ঢাকা শহরে ত্রিশটি মহল্লার তরুনদের উপস্থিতিতে অনেক রকমের রঙে সাজানো এই মিছিল উদযাপনের ক্ষেত্রেও নানা রকমের অভিনব সব খেলা আর প্রদর্শনীতে পরিপুর্ণ ছিল। ২০০৪ সাল পর্যন্ত এই ঈদ মিছিলের আয়োজন চলে। এরপর একরমকের বন্ধই বলা যায় এই ঐতিহ্যবাহী ঈদ উদযাপনের ক্ষেত্রটি।

আমি আমার জীবনে তিনটি ভিন্ন ভিন্ন দশকের ঈদ দেখেছি। আমার মনে হয় ফিলোসফির ক্ষেত্রে ঈদ বরণে তেমন কোন পরিবর্তন হয়নি। ঈদকে কেন্দ্র করে পারিবারিক বন্ধন-সামাজিক একতা বা ধার্মিক বোধ অনেকটাই একইরকম থেকেছে মনে হয়েছে। ঈদের খাবারের ক্ষেত্রে হয়তো নতুন কিছু যুক্ত হয়েছে, পোষাকের ক্ষেত্রে পরিবর্তন এসেছে কিন্তু মুল ভাবকে অতিক্রম করে নয়। এখনো ঈদে ছেলেদের পাঞ্জাবিই মুল পোষাক, মেয়েরা সেই সালোয়ার কামিজ বা কোন কোন ক্ষেত্রে শাড়িই পরে। তবে অনেকখানিই বদলে গেছে বিনোদনের ক্ষেত্র। আগে ঈদে এলাকায় এলাকায় অনুষ্ঠান হতো, নাচ-গান হতো, নৌকা বাইচ, কুস্তি-যুদ্ধ, গ্রামীণ খেলা বা বাজপাখীর লড়াই দেখা যেত। ঈদগাহের আশেপাশে মেলাও দেখা যেত। এখন বিনোদনের ক্ষেত্র দখল করে রেখেছে টেলিভিশন। সাত দিন/দশ দিন ধরে টিভিতে অনুষ্ঠান হতেই থাকে। মানুষও বন্দি হয়ে যায় ঘরে ঘরে।

বদলায়নি শুধু শিশুরা। দুইটি শিশুর নতুন জামা পরে ঈদ গাহ আসতে দেখাটাই সবচেয়ে সুন্দর দৃশ্য ঈদের দিনে। এখনো তেমনি দেখা যায়। শিশুরা লাল-নীল-সবুজ পাঞ্জাবি পরে বা মেয়ে শিশুরা ঝলমলে পোষাকে ঈদ পালন করে -অকারনেই হাসে -অকারনেই ছুটে বেড়ায়, ঈদের দিনের এই দৃশ্যে কোন পরিবর্তন নেই।

আমার অন্য লেখা পড়ুন

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here

Reviews

Popular Articles