শরীর ভালো লাগছে না। টেবিল ল্যাম্পটা জ্বলে আছে, অথচ বাইরে পরিস্কার আলো। ঘরের পর্দা নামানো। চাইলেই শুয়ে শুয়েই পর্দা নামিয়ে আলো নেভানো যায়। কিন্তু ইচ্ছে করছে না। স্পর্শের খিদে গত ক’দিন আমাকে পাগল করে তুলেছে।

ঘরে বেশ ক’টি রোবট মেয়ে রয়েছে । যে কোন সত্যিকারের নারীর চেয়ে ওদের চামড়া আরও মসৃণ, তুলতুলে। চাইলে ওদের থেকে যথেষ্ট আদরও আদায় করে নিতে পারি। কিন্তু আমার ইচ্ছে করছে, একেবারে রক্ত মাংসের কাউকে। যার ধমনী প্রবাহের উত্তাপ আমাকে ফুটন্ত জলের মতো উষ্ণ করে তুলবে।

সত্যিকারের মেয়ের সাহচর্য পাওয়া এ যুগে সত্যিই দুস্কর। আমি এখন আপাতত একজনই মেয়েকেই চিনি- মেয়েটি স্প্যানিশ, ওর নাম মার্থা। মার্থাকে বলেছিলাম একটা মেয়ে রোবটের জন্য একটা মেন্টাল সিমুলেটর ডিজাইন করে দিতে, যে বৃষ্টি হলে আমাকে বলবে, জিসান, চলো বৃষ্টিতে ভিজি।

আমি যে ল্যাবে কাজ করি, মার্থা সেখানকার ফিমেল রোবোটগুলোর সাইকোলজিক্যাল মডেল এনালিস্ট। পুরুষদের ঠিক কি রকম নারী দরকার এ ব্যপারে খুবই অভিজ্ঞ সে। তবুও মার্থা এই অদ্ভুত অনুরোধ, অন্তত তার কাছে, শুনে আমাকে বলল,

– যা করতে চাও, তা যদি করতেই পারো, তবে রক্ত মাংস দিয়ে কি করবে?

আমি মার্থাকে বুঝিয়ে বললাম

– দেখো, কোন রাসায়নিক ক্রিয়া ঘটার আগে তাপমাত্রা কিছু বাড়িয়ে নিতে হয়। আমার একটা স্পর্শ দরকার ভীষণ আর যৌনতাই মূল লক্ষ্য নয়।

মার্থার গায়ে নীল রঙের কার্ডিগ্যান, কিছুটা চিন্তিত ভাব মুখে এনেছে, কথা বলতে বলতে হাতের একটা আঙুল ফুটিয়ে ফেলেছে সে। কিছুটা অপ্রস্তুত যেন। আঙুল ফুটিয়ে হাটুতে মুখে রেখে সে বলল,

– তুমি ভুল লোককে নক দিয়েছো জিসান। বৃষ্টি হলে আমার বেরোতেই ইচ্ছে করে না। যা নিজে বুঝি না, তা অন্যের মাথায় ঢোকায় কি করে বলোতো!

– কেন তুমি যাদের বানাও, তাদের সব চারিত্রিক ধরণ কি তোমার সাথে যায়?

– যায়, তা বলিনি। তবে সেই ধরণ সম্পর্কে আন্দাজ করে নিতে পারি।

– তাহলে আমারটাও বোঝো। ধরো, মন খারাপ হলে ওর সাথে কথা বলতে পারবো আর ওকে যখন আদর করব, ও আদর চাইবে কিন্তু মনে মনে প্রচুর বাঁধা দেবে। তারপর এরকম যুদ্ধ যুদ্ধ খেলতে খেলতে একসময় ওকে জয় করে নেবো।

আমার কথা শুনতে শুনতে মার্থা হাটুতে থেকে মুখ সরিয়ে ওর হাতগুলো কার্ডিগ্যান এর ভিতর ঢুকিয়ে নিলো, তারপর ওর কিছুটা বড় দাঁতগুলো বের করে হাসলো। মার্থার হাসি আমার ভালো লাগলো না। কারণ জানতে চাইলাম,

– হাসছো যে?

– তুমি কি আজকাল সিনেমা দেখছো খুব জিসান?

– না, সিনেমা দেখার সময় কোথায়? আর তুমি জানো এসব ফালতু কাজে সময় নষ্টের আগ্রহ আমার নেই।

– সে ভালো কথা, কিন্তু তুমি তো খুব গম্ভীর কিছু বলনো যে খুব ভেবে মাথা চুলকে তোমাকে উত্তর দেবো?

– খুব শিশুতোষ কিছুও বলিনি। না মার্থা, তুমি বুঝতে পারছো না, বড়শিতে একেবারে গেঁথে যাওয়া মেয়ে একদমই পছন্দ নয় আমার। এই রোবটগুলো যাচ্ছেতাই, যা বলি এরা তাইই করে।

– কিন্তু ম্যাশিন মানেই তো তাই হবার কথা, তাই না?

– জানো, এদের সাথে থাকতে থাকতে মনে হচ্ছে বহুদিন শ্বাস নিতে পারছি না, একটা বদ্ধ নদীতে আটকা, যেখানে জমে আছে অসংখ্য বিশ্রী গন্ধের পুরু পলিমার। জানো, আমি আমার নানা-নানুর সম্পর্কটা দেখেছি। নানু ডানে বললে নানা বাম দিকে গিয়ে নানুকে রাগিয়ে দিয়ে ঘুরে আবার ডান পথে চলে আসতো। কি ইন্টারেস্টিং না?

ভেবেছিলাম মার্থা আমার জোকটা নেবে। কিন্তু মায়ের কথা বলতেই সে চুপ হয়ে গেলো, এখন বাইরে তাকিয়ে আছে জানালা দিয়ে। অফিসের পিছনের ব্যাকইয়ার্ডের লন যেখানে অনেক আগে পিকনিক হতো। বেশ কিছু ওক আছে ওখানে, এই শেষ বিকেলে ওকের দীর্ঘ ছায়া পড়েছে। মার্থার দীর্ঘ মুখটাকে মনে হচ্ছে ওকের ছায়া।

মার্থার জন্ম অন্য মানুষের মতো ঠিক স্বাভাবিক ভাবে হয়নি। তাকে জেনেটিক কোড অনুযায়ী তৈরি করা হয়েছে। ওকে দেখে এলেক্স প্রথম দিনই বলেছে, “এই বলোতো ইঞ্জিনিয়ার মেয়েগুলো এরকম কেন? এদের যা কিছু সব মাথায়, তাই বলে গতরে কিছুই থাকবে না”?

এলেক্স ফরাসি। আমি ওর অশ্লীল ইঙ্গিতে কিছু বলিনি সেদিন। তবে ল্যাবে জন্মালেও মার্থা অবিশ্বাস্যভাবে মেয়েদের মন বোঝে। ওকে দেখলে মনে হবে, একটা বড়ো পরিবারের অনেক ভাই বোনের মধ্যে ছোটাছুটি করে ও বড় হয়েছে।

না মার্থা খুব স্মার্ট মেয়ে। কিছুটা আঘাত তাকে অবশ্যই করেছি। তবু মুহূর্তেই সে নিজেকে সামলে নিয়ে প্রসঙ্গ বদলে ফেললো।

– কফি খাবে জিসান? খেতে খেতে চলো তোমার আবদারের বিস্তারিত শুনি।

মার্থাই সুইচটা টিপলো। মাইক্রোয়েভ থেকে একটা হ্যান্ড বেরিয়ে আমাদের কফি দিয়ে গেলো। এই অফিসের কফি খুবই ভালো। অটোম্যাটিক কফি গিভার এই প্রডাক্ট মার্কেটে লঞ্চ হয়েছে কয়েক বছর আগে। এটা ২৭০ ডিগ্রী কৌণিক দুরত্বে ১০০ মিটার পর্যন্ত হাত প্রসারিত করতে পারে। কফিতে চুমুক দিয়ে মার্থাকে স্বাভাবিক করতে বললাম,

– জানো মার্থা আমার নানীকে বলেছিলাম এই মেশিনের কথা। নানী বলল, এটা মেশিন নয়। নানীর ধারণা, এই ল্যাবে জ্বীন আছে, সেই হাত বাড়িয়ে টেবিলে টেবিলে কফি দিচ্ছে।

– জ্বীন? সেটা কি?

– মানে ধরো ছেলে উইচ।

– তোমার নানী তো ভারী সরল। কতো বয়স ওনার?

– এই ধরো একশোর কাছাকাছি। তবে বুড়োদের জন্য এই প্রযুক্তি একটা অভিশাপ হয়ে গিয়েছে জানো। এই দীর্ঘায়ুর ওষুধ খেয়ে একা একা কারো বাঁচতে ভালো লাগে!

– একাকীত্ব মনে হচ্ছে তোমাকেও পেয়ে গেছে জিসান। তুমি দেশে যাবে?

– না সেরকম কিছু নয়।

– আর তোমার বাবা-মা?

– বাবাকে মা খুব ভালবাসত। কিন্তু বাবা মাকে কোনদিন সম্মান করেনি। মা একদিন বিষাদে বিষাদে ঝুলে পড়ে তার ঘরের সিলিং এ। আমি তখন অনেক ছোট। আমাকে অবশ্য মায়ের মৃত্যুর অন্য কারণ বলা হয়েছিলো। বড় হয়ে পরে সব জানতে পেরেছি।

তারপর মার্থা যেন কিছুটা অন্যমনস্ক হয়ে পড়লো। ওর খয়েরী চোখের দুটো গোলক যেন সাদা সমুদ্রে ভাসছে। প্রশ্ন সেই করলো-

– তবে এখন কি তোমার বাবার উপর খুব রাগ?

– না, রাগ নেই। তবে শীতল ঘৃনা আছে। আচ্ছা বাদ দাও এসব। বাবা তার নতুন ছেলেমেয়েদের নিয়ে ভালোই আছে। দেশ বলতে আমার কাছে এখনও নানু। গত বিশ বছরে পশ্চিমে পৃথিবী যেভাবে বদলেছে, পূবে অতটা হাওয়া পড়েনি। জানো আমারই জন্মের পর নানু আমাকে একটা সরিষার বালিশ দিয়েছিল মাথা গোল করার। দাঁড়াও তোমাকে বুঝিয়ে বলি সরিষা কি! তুমি আবার হাসবে না তো! তুমি যে মাস্টারড সস খাও, সেটার গ্রেইন।

মার্থা হাসল, তবে হাসিতে বিষাদ। কফিটার কাপটা রেখে বলল, তোমার কথা শুনলে মনে হয়, আমারও একটা দেশ থাকলে ভালো হতো।

– তুমি যাবে আমার সাথে?

মার্থা কথা ঘুরিয়ে নিলো।

– তোমার সেই বালিশ কি এখনও আছে?

– হ্যাঁ আছে আর সেটাতে মাথা রাখলে এমন ঘুম এসে যায়। আর ঘুমের মধ্যে দেখি-একটা হলুদ ক্ষেত, মা আমার পিছনে ভীষণ জোরে ছুটছে। আমাকে একসময় ধরে ফেলে। মায়ের গরম শ্বাস আর বুকের ধুকপুকানি আমার মুখের উপর এসে পড়ছে।

মার্থা মনে হলো আমাকে ঠিক শুনছে না। তার চোখে জলের উদাসীনতা, চুপ করে থাকলো কিছুক্ষণ। তাকে স্বাভাবিক করতেই মজার ছলে বললাম, তোমাকে নিয়ে গেলে, নানু খুশি হবে খুব আর ভাববে অবশেষে কাউকে বিয়ে করেছি।

– আজকের নিউজটা দেখেছো? রাশানরা এখন অনেককেই প্রশিক্ষণ দিচ্ছে। গতবারের হারের শোধ ওরা তুলে ছাড়বে। যুদ্ধ বিগ্রহ ছাড়া তো বিনোদনের কিছু নেই আর এ পৃথিবীতে। তবে তুমি সংখ্যা বাড়ানোর দ্বায়িত্ব নিতে চাইলে কিন্তু তোমার ঐ যে কি রকম যেন বিবরণ দিচ্ছিলে, ওরকম ঢঙ্গী মেয়ে ছাড়াও পারবে।

যদিও মার্থা মুখ টিপে খুব সামান্যই হাসলো, তবু ওর নিরাসক্তি ভাংগাতে আরেকটু নাড়া দিলাম।

– আরে তুমি তো দেখি ইর্ষায় জ্বলছো।

– দূর, ঐ প্রসঙ্গ বাদ দাও তো এখন। এই আমাকেই দেখো। বাবা নেই, মা নেই অথচ মুরগীর ডিমের মতো একদিন ফুটে মানুষ হয়ে গেলাম।

কথা সত্য, মাঝে মাঝে ওকে নিয়ে ভাবি। এখন মানুষ চাইলেই নিজের চেহারার বদল করতে পারে। মার্থা কেন করেনি জানি না। তবে এটা অস্বস্তিকর প্রশ্ন। এরকম প্রশ্ন করা মানে—তাকে ঘোষনা দিয়ে বলা, তুমি দেখতে খুব কুৎসিত, তোমার উচিৎ এক্ষুনি নিজের চেহারা বদল করা।

এলেক্স বলছিলো, মার্থাকে যিনি কোড করেছেন, তার স্যাম্পলটি নাকি এক নারী সাইন্টিস্ট কৌশলে বদলে দিয়েছিল। মার্থার হবার কথা ছিল অপরুপা কেউ, যার হিউমার আছে, যে সংবেদনশীল, একই সাথে মেধাবী।

নারীবাদীরা নাকি এটি মানতে চায়নি। তাদের কথা—পুরুষ ও নারীর শারীরিক অবয়বে যে পার্থক্য রয়েছে তা রীতিমতো অপ্রয়োজনীয়। শিশু খাদ্য এখন শতকরা একশো ভাগ মাতৃদুগ্ধের মতো আর পুরুষের মনে যৌন ভাবাবেগ প্রবেশের জন্য রোবটগুলো অনেক বেশি সক্ষম। নারীদের আর আকর্ষণীয় হবার প্রয়োজন নেই। বরং নারীর আকর্ষণীয় শরীর তাকে নিরাপত্তা ঝুঁকিতে ফেলতে পারে।

কথাটা শুনে হেসেছিলাম, দুষ্টুমি করে বলেছিলাম, তাহলে নারীবাদীরা কি মোল্লাদের সাথে যোগ দিলো?

এলেক্স প্রচুর উইড খায়। যদিও অফিসে খায় না, তবু লাঞ্চ আওয়ারে খেয়ে আসে আর ওর শরীর থেকে আসা বুনো গন্ধটা মাথা ঘুরিয়ে দেয়। সেদিনও ওই মাথাধরা তীব্র গন্ধ ছড়াচ্ছে এলেক্স আর গন্ধটা যেন কেউ আমার ভিতরে সিরিঞ্জ দিয়ে পুশ করে দিচ্ছে সেদিন।

– আচ্ছা জিসান, একটা পুরুষ দেখাতে পারো যে পার্ভাট নয়?

– কেন, এইতো আমিই, তোমার সামনেই দাঁড়িয়ে রয়েছি।

– সাধু সেজোনা, তোমার এই উত্তেজিত চেহারার সাথে এই সাধুর বানী যায় না।

উইডের প্রভাব সেদিন আমাকেও পেয়ে বসেছিল কিনা জানি না। মার্থার সাথে আলাপ শেষে উঠে এলাম ওয়ার্ক স্টেশনে। আমাদের এই গবেষণাগার খুব বিখ্যাত। এরা পৃথিবীর সবচেয়ে ভালো সঙ্গী পুতুলগুলো তৈরি করে। পুতুলগুলো খুব ভালো গল্প করতে পারে, উত্তেজনাও তৈরি করতে পারে। এ ছাড়া নানা প্রয়োজনে গ্রাহকের অর্ডার অনুযায়ী এদের কাস্টমাইজড করা হয়।

আজ সকালে একটি মেয়ে রোবট কাস্টমারের কাছ থেকে ফেরতে এসেছিলো। এক্সরে করিয়ে এসেমব্লিং দেখলাম। তারপর আবার ওর ওএস রিলোড করলাম যেন ও পুর্বের কথা ভুলে যেতে পারে। এসব করতে করতে প্রায় দুপুর।

লাঞ্চের জন্য কিছু সময় থাকে, তবে লাঞ্চের ঠিক দরকার নেই। একটি পিল খেলে এক মাস না খেয়ে থাকা যায়। তবে মাঝে মাঝে কফিটা আমাকে খেতেই হয় শরীর চাঙ্গা করতে।

মাঝে মাঝে নানান অদ্ভুত অর্ডারও আসে। একবার এক নতুন উপাসনলায় উদ্ভাবন হবে, একজন ধর্মযাজক তৈরির অর্ডার আসলো। আমরা নিষ্ঠার সাথে তৈরি করলাম কিন্তু অনুষ্ঠানের দিন, আমাদের বানানো যাজকটি ঐ বৌদ্ধ মঠে কুরআন তেলোয়াত শুরু করলো।

তবে এই ভুলটা ছিল ইচ্ছাকৃত। আর এটা করেছিল এলেক্স, সবকিছু নিয়ে ঝামেলা পাকানো ওর অভ্যেস। তবে ওর পড়াশোনা দারুন, সবকিছু নিয়েই প্রচন্ড গবেষণা করে, যুক্তি ছাড়া তাকে একটি শব্দও বিশ্বাস করানো যায় না। মাঝে মাঝেই এলেক্স জ্ঞান দেয় এনাল্যিটিক্যাল ফিলোসফি নিয়ে।

এলেক্স বলে, দেখো মানুষ ধর্ম কর্মের প্রতি আগ্রহ বিশ্বাস হারিয়েছে অনেক আগেই। এখন আর কেউ ধর্মের চর্চা করে না বলে তুমি যাজক খুঁজে পাও না। তবু এরাই আবার ধর্মটাকেই টিকিয়েই রাখতে চায়। কেমন স্ববিরোধী ব্যপার বলোতো!

– তবে কেন টিকিয়ে রাখতে চায়?

– তুমি কেন বুঝতে চাইছো না জিসান! যে ঈশ্বরকে সে বিশ্বাস করে না, সেই ঈশ্বরের সাথে লড়বার আত্মবিশ্বাস মানুষ এখনও অর্জন করতে পারেনি।

– গত দু’দশকে প্রযুক্তি জীবনকে যেখানে নিয়ে এসেছে, মানুষ এর চেয়ে আর কি ক্ষমতাধর হতে পারে এলেক্স?

– তুমি দেখে নিও, মানুষ তার ভাবনার চেয়ে বেশি ক্ষমতাধর হবে আর সেটা ক্রমশই ঘটতে থাকবে।

আমি এলেক্সের কথায় সেদিন চুপ ছিলাম। সত্যি একবার আমার ভাবনার বাইরে একটি কান্ড ঘটেছিলো। এক আরব শেখ কিছু নারী সঙ্গী রোবটের অর্ডার দিয়েছিল। কিন্তু কিছুদিন পরপরই সে ওগুলো ফেরত আনতো। কারণ সে পুতুলগুলোকে কালো ভেইল পরাতো, তাই হিট সিঙ্ক কাজ করতো না। তাপমাত্রা বেড়ে, সিস্টেম শাট ডাউন করতো। সে ঐ মেয়ে পুতুলের একটি নামও দিয়েছিল ‘সিতারা’।

আমি যখন সিতারাকে বললাম, কি হয়েছে? সিতারা বলল,

“গরমে মরছি। তুমি বুঝতে পারছ না, আমাকে সুইমিং পুলে নিয়ে যাও। না, না দাঁড়াও সেখানে তো আবার অন্য পুরুষেরা আছে।”

বুঝতে পারছিলাম সিতারার মনোজগতে একটা বড় পরিবর্তন হয়েছে। কিন্তু যেটা আমি ঘটাইনি? যন্ত্রের এআই মডেল নিজে থেকেই এনেছে।

বিকেলে অফিস থেকে বেরোতেই একটা রোবট বাউ করল। প্রায় জনমানবহীন রাস্তাঘাটে দিব্যি চলা যায়। পৃথিবী অনেকটাই নিরাপদ। আদালতে তেমন বিচার নেই। বলা যায় জজ সাহেবরা ঘুমিয়ে ঘুমিয়ে বেতন তুলছে।

বাসায় পৌঁছে ঘুমিয়ে পড়লাম আর ঘুম থেকে উঠে একটা অদ্ভুত চিঠি লিখলাম।

“প্রিয় মার্থা,

তোমাকে খুব দেখতে ইচ্ছে করছে। তোমার চুলের গন্ধ নিতে চাই। মানুষের গন্ধ কেমন হয়, অনেকদিন জানি না আমি। মানুষের গন্ধ নিতে নিজের কাপড় শুকলাম। কিন্তু কিছু পেলাম না। তুমি তো জানো আমরা এখন আর কেউ কাপড় বদলাই না, ওয়ারেবল কম্পিউটিং এর জন্য তা নিষ্প্রয়োজন।

প্রিয় মার্থা, এই মুহূর্তে আমার হাসনাহেনা ফুলের গন্ধের জন্য পাগল লাগছে। অথচ হাসনাহেনা আমি জীবনে দেখিনি।

আমি তোমাকে সবুজ একটা শাড়ির কোড পাঠিয়েছি। গাড় শ্যাওলার মতো সবুজ। আচ্ছা, তোমাকে শাড়ি বিষয়টি ঠিক কি, সেইটা আসলে আগে বুঝিয়ে বলি। শাড়ি হলো অনেক লম্বা কাপড়, অথচ এটা পরে তুমি নিজেকে ঢাকতে পারবে না। আর এটা পরে তুমি যদি তোমার পছন্দের মানুষের কাছে যাও, তার ইচ্ছে করবে টান দিয়ে খুলে তোমাকে বের করে আনে”।

এই চিঠি নিয়ে মার্থা নিশ্চয়ই এলেক্সকে কিছু লিখেছিল। পরদিন এলেক্সের টেক্সট আসলো-জিসান তুমি কি অপ্রকৃতস্থ? তুমি এইসব মার্থাকে কি বলেছো?

খুব রাগ হয়ে গেলো। মার্থাকে যাই বলি, তাই বলে কেন সে এলেক্সকে জানাবে। টেবিলে একটা ঘুষি মেরে দাঁত কামড়িয়ে বললাম,

– যাই বলি, তুমি কি এখন এটা থেকে এটা দার্শনিক তত্ত্ব বের করবে আর ঝামেলা পাকাবে?

– তত্ত্ব বের করি না করি, তোমার মতো পার্ভাটকে নিয়ে আমার অতো সময় নেই। শুধু এটুকু বলি, তুমি মার্থাকে নিয়ে খেলো না, তোমার বানানো মেয়ে পুতুলগুলোর ব্যাপারে সাবধান থেকো।

এলেক্স আর কিছু বলেনি, তবে মার্থার সাথে তার কি কথা হয়েছে জানি না। ক’দিন পর দেখি কলিং বেল বাজছে। মার্থার হাতে অর্কিড, সবুজ শাড়ি পরনে। মার্থা বসলো ব্যাল্কনিতে। উন্মুক্ত হাওয়া আর সুর্যটা তখন ডুবছে। মনে হচ্ছিলো মার্থার চেয়ে মায়াবতী নারী কখনো দেখিনি। ওর সমস্ত মেয়েলি ত্রুটি যা নিয়ে আমি এলেক্স উপহাস করেছি, আজ কিছুই চোখে পড়লো না। বরং যেন মার্থার চেয়ে মেয়েলি মেয়ে আর হয় না।

মার্থাকে স্পর্শ করতে চাইলাম, ও বাইরের হাওয়ার মতো ছুটে গেলো। দূর থেকেই বলল,

– জিসান তুমি ল্যাবে যাও না যে? বস তোমাকে কাজ থেকে বাদ দিয়ে দেবে।

– দিলে তো খুব সমস্যা নেই। আগামী একশো বছর খেয়ে বাঁচার জন্য সব পিল মজুত করে রেখেছি আমি। এই এপার্টমেন্ট এর ভাড়া তো? থাকার জায়গা কোন বিষয় না। এই বিল্ডিং এ কতো এপার্টমেন্ট খালি পড়ে আছে। মানুষের আত্মহত্যার গ্রাফ দেখেছো?

হঠাৎ আমি উষ্ণতা টের পেলাম। আস্ত দুপুরটাই যেন আমাকে ছুঁয়ে দিচ্ছে। এই উত্তাপ আজ সমস্ত আশাভঙ্গের খেদ ঝলসে দিক। মার্থা তার হাত আমার কপালে ছোঁয়াতে ছোঁয়াতে বলল,

– কেন এই গ্রাফ কি তোমাকে আশ্বস্ত করছে বসবাসের জায়গার নিশ্চয়তা নিয়ে? তুমি ওদের দলে অংশগ্রহণ করতে চাও?

না, মার্থা কথা শেষ করতে পারেনি। একটি মেয়ে রোবট এসে মার্থার বুকে লাল ছুরি বসিয়ে দিলো। বুঝতে পারছিলাম না কি করবো। নিমিষেই একটা জীবন্ত তাজা শরীর নেতিয়ে শীতল মৃতদেহ হয়ে লুটিয়ে পড়লো আমার বুকে। মানুষের রক্তের রঙ এতো লাল গতো ত্রিশ বছরে আমি ভুলে গেছি। ওর মুখ থেকে সাদা ফেনা গড়িয়ে পড়ল, ফেনাগুলো যেন বরফের নদীর ঢেউয়ের মতো। স্রোতে ভেসে তীরে এসে ওরা জমে যাচ্ছিল। ঘাতক রোবটটি তখনও পাশে দাঁড়িয়ে, ওর নাম এনা, যাকে আমি নিজ হাতে তৈরি করেছিলাম।

এনাকে প্রশ্ন করলাম- তুমি এটা কী করলে, কী করলে এনা?

এনা উত্তর দিলো- তোমার মনে আছে জিসান, তুমি আমাকে এমন করে বানিয়েছিলে যে আর কাউকে ভালবাসার ভাগ দিতে পারবো না আমি।

– কিন্তু সে তো আর অন্য যন্ত্রমানবীর সাথে। মার্থা তো সত্যিকারের মানুষ! তোমাকে তো স্পষ্ট সে কথা বলা হয়েছিল।

– তোমাদের মানুষদের হাতে আর কিছুর নিয়ন্ত্রণ নেই জিসান। এখন আমরাই পৃথিবী চালাবো।

– তুমি দূর হও, উদ্ভট অসহ্য সব কথা বলছো। তোমাকে আর চাই না, বেরিয়ে যাও তুমি।

‘কিন্তু সে তুমি না চাইলেও আর কিছুই করতে পারবে না’, এই বলে এনা আমাকে পাগলের মতো জাপটে ধরে আদর করতে লাগলো। হাজার চেষ্টায়ও নিজেকে ছাড়াতে পারলাম না। সে বারবার ছুঁয়ে দিচ্ছিল আর বলছিল সেই নোংরা উত্তেজক কথাগুলো যেটা আমিই ওকে শিখিয়েছিলাম। অসহ্য লাগছিল এনার সেই শীতল সিলিকন স্পর্শ। বিরক্তিতে চিৎকার দিয়ে উঠলাম। আমি তো মানুষের স্পর্শ পেতে চেয়েছিলাম। মার্থাকে, মার্থা মৃত হলেও আমি শেষবারের মতো ছুঁতে চাই তাকে। কিন্তু না, পারলাম না। আমি হাত বাড়াবার আগেই, এনা ততক্ষণে তাকে জানালা দিয়ে বাইরে ছুঁড়ে ফেলেছে।

লেখকঃ ড. জান্নাতুন নাহার তন্দ্রা
(শিক্ষক, কবি ও কথাসাহিত্যিক)


LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here