নানাবিধ সমস্যা অথবা নেহায়ত আলসিপনার কারণে লেখাটা দিতে দেরি হয়ে গেলো। বছর পাঁচেক আগে লিখে রাখা। তুরস্ক আর সিরিয়ার ভয়াবহতার পর তাই একটু এডিট করে ছেড়ে দিচ্ছি। প্রিয় পাঠক সময়টা কিন্তু বেশ কবছর আগের।
প্রথম পর্ব ২০১৬
হ্যাঙ্গিং রক থেকে ঘুরে এসে কেবল একটু জিরোচ্ছি। ফেসবুকে বসতেই জনৈক বন্ধুর ভূমিকম্প বিষয়ক স্ট্যাটাস চোখে পড়লো। স্বভাবসুলভ রসিকতা করলাম। তখনো বুঝিনি আসলে কি যাচ্ছিলো দেশের মানুষের উপর দিয়ে। এরপর ভাইবারে বাবা নক করলেন। কিছুক্ষণ পর দেখি স্ট্যাটাসের বন্যা। এই ভোর রাতে মানুষ যখন জেগেছে তখন বেশ জোরালো কিছুই হবে। আরেক ছোটভাই এর বাসায় ফ্রিজের উপর থেকে কেচাপের বোতল পড়ার ছবি দেখে বাসায় ফোন দিলাম। শুনলাম খুলনায় বাবা মা রাই নাকি বাসা থেকে বের হয়ে এসেছিলেন। বুঝলাম ঢাকায় তাহলে কি না হচ্ছিলো। ৬.৭ মাত্রার এই ভূমিকম্পের উপকেন্দ্র ছিলো ভারতের মণিপুরের ইম্পফল থেকে ২৯ কিমি পশ্চিমে, গভীরতা ৫৫ কিমি।
উপকেন্দ্র বা এপিসেন্টার হচ্ছে ভূগর্ভের ঠিক যেই স্থানে প্রথম স্ট্রেইন এনার্জি (বহুদিন ধরে বস চাপের মধ্যে রাখলে আমরা যেরকম একদিন বিদ্রোহ করে বসি ক্ষেপে গিয়ে, সেইরকম) রিলিজ হয় ঠিক সেই বরাবর পৃথিবীর উপরিভাগের স্থান।
প্রশ্ন হলো বাংলাদেশের মত densely populated country কতটা ঝুঁকির মধ্যে আছে। এর জন্য দ্যাখা দরকার বাংলাদেশের আশপাশ দিয়ে কি কি ফল্ট লাইন গিয়েছে এবং নিকট অতীতে তারা কি রকম ভূমিকম্পের সৃষ্টি করেছে।
পুরো পৃথিবী যে অংশে আমরা দাঁড়িয়ে আছি, মিনারেল আহরণ করছি বা যেই কর্মকাণ্ড চালাচ্ছি তা আসলে কতগুলো ভাসমান প্লেট, ভূভাগের প্রচণ্ড উত্তপ্ত গলিত পদার্থের উপরে এই অপেক্ষাকৃত হালকা ভাসমান প্লেট ঘুরে বেড়াচ্ছে। এই গতি যদিও ধীর, তবু প্লেটে প্লেটে ঠোকাঠুকি চলছে। তাই দ্যাখা যায় অধিকাংশ ভূমিকম্প বিভিন্ন প্লেটের বাউণ্ডারিতে সৃষ্টি হচ্ছে।
ছবিতে দেখতে পাচ্ছি নানান রকম প্লেট, এই প্লেটের উপরেই দাঁড়িয়ে দুনিয়াদারি।
পরবর্তী পর্বে আরো কিছু সাধারণ আলোচনা নিয়ে হাজির হবো।
বছর কয়েক আগে ন্যাশনাল জিওগ্রাফির ওয়েবসাইটে পাবলিশ হওয়া আর্টিকেলে রিখটার স্কেলে ৯ মাত্রার ভূমিকম্পের সম্ভাবনা নিয়ে হুমকির মুখে আছে বাংলাদেশ। লেখাটার রেফারেন্সের বিরোধিতা করে ঢাকা ইউনিভার্সিটির একজন প্রফেসরকেও দেখলাম কিছু লিখতে। তবে মোদ্দা কথা কিন্তু একটাই, বেশ বড় একটা ভূমিকম্পের ঝুঁকির মধ্যে থাকছে বাংলাদেশ।
ভূগাঠনিক দিক থেকে বাংলাদেশের ঠিক নিচের জায়গাটা ইণ্ডিয়ান ক্রেটন (craton) এর এক কিনারে আর তিনটে টেকটোনিক প্লেটের জংশনে অবস্থিত। এর মধ্যে দুটি ইণ্ডিয়ান আর ইউরেশিয়ান প্লেট আর আরেকটি বার্মিজ মাইক্রোপ্লেট। ক্রেটন যথেষ্ট স্থিতিশীল এবং মোটেও সক্রিয় নয়। সম্ভবত এ কারণেই বাংলাদেশের অভ্যন্তরে ভূমিকম্পের তেমন উৎপত্তি দেখা যায় না।
যাই হোক, ইন্দো ইউরেশিয়ান প্লেটের বাউন্ডারিতে উত্তরে হিমালয়ান পর্বতমালা আর ইন্দো বার্মা প্লেটের বাউন্ডারিতে পূর্বে আরাকান পর্বতমালা। সমস্যা টা যেটা হচ্ছে, ইন্ডিয়ান প্লেট ফি বছর প্রায় ৩৫-৪৫ মিলিমিটার করে অগ্রসর হয়ে এই দুই প্লেটের নিচে চলে যাচ্ছে। তাইতো প্রতিবছর ই রিপোর্ট পাচ্ছি মাউন্ট এভারেস্টের উচ্চতা বেড়েই চলেছে। নিচের ছবি দ্রষ্টব্যঃ
আরো কিছু একটিভ ফল্ট রয়েছে যেমন ডাউকি ফল্ট যেটা মেঘালয় বাংলাদেশ সীমান্তে অবস্থিত শিলং প্লাটুর (Plateau) দক্ষিণাংশে অবস্থিত। এছাড়াও আসাম সিলেট ফল্ট, চিটাগাং-মিয়ানমান ফল্ট আর বাংলাদেশের অভ্যন্তরে রয়েছে মধুপুর ফল্ট, যারা দেশের অভ্যন্তরে মাঝারি থেকে বড় ভূমিকম্পের কারণ হতে পারে।
এ রকম এলাকাকে জিওলজিস্টদের ভাষায় সাবডাকশান জোন বলে। নিচের ছবিতে সাবডাকশান জোন দেখতে পারছি আমরা।
তবে সবসময় এই গতি স্মুথলি চললে তো হতোই। সমস্যা দেখা দেয় এই বিস্তৃত অঞ্চল জুড়ে ঘষর্ণের ফলে। কন্টিনেন্টাল ক্রাস্টগুলো যাত্রাপথে বাধাপ্রাপ্ত হলে তাতে বিপুল পরিমাণ স্থিতিশক্তি জমা হয়। এক বলে লকড (locked) এনার্জি। জমা হতে হতে একদিন যখন এই লক ছুটে যায়, তখন তা প্রবল কম্পনে প্রকম্পিত হয়ে সব উগড়ে দেয়। আর তখনই ভূমিকম্পের সৃষ্টি হয়। এখন কোথায় যে বিপুল পরিমাণ শক্তি জমা হচ্ছে তা প্রেডিকশন করাটা খুব মুশকিল। বলতে গেলে অসম্ভব।
আপাতত সেদিকে না গিয়ে আমরা পরবর্তীতে বাংলাদেশের আশেপাশে ভূমিকম্পের অতীত ইতিহাস নিয়ে কিছুটা আলোচনা করার চেষ্টা করবো। অতীতে বাংলাদেশে ১৭৬২, ১৭৮৭, ১৮১২, ১৮২২, ১৮৪২, ১৮৪৫, ১৮৪৬, ১৮৬৫, ১৮৮৫, ১৮৮৭ সালে ভূকম্পন অনুভূত হয়।
নীচের ছবিতে আমরা বাংলাদেশ ও তাঁর আশেপাশে সংঘটিত কিছু ভূমিকম্পের উৎপত্তিস্থল ও মাত্রা দেখতে পারছি।
আশার কথা হলো এরকম ছোট ছোট ভূমিকম্পের মাধ্যমে স্ট্রেইন এনার্জি রিলিজ হয়ে যাচ্ছে। যদি এগুলা বন্ধ থাকে, তবে সেটা কোন পূর্বাভাস দেয় কিনা কিনা সে বিষয়ে তর্ক বিতর্ক হতেই পারে।…(চলবে)
Faisal Kabir, PhD, Currently working as a postdoctoral research scholar at Rowan University.