শিরোনামঃ আমি ডোন্ট মাইন্ড ফ্যামিলির মেয়ে!
আমার নাম সোনিয়া, জন্মসাল ১৯৮৬। ছোটবেলা থেকেই সবাই আমাকে বুলিং করতো। এই ধরেন ক্লাস ফোর, তখন থেকে! আমি অবশ্য বুলিং বলে কোন ওয়ার্ড আছে এটাই জানতাম না, জেনেছি অনেক পরে এসে! ক্লাসে আমাকে সবাই ডাকতো স্যানিটারি ল্যাট্রিন বলে। আমি ডোন্ট মাইন্ড ফ্যামিলির মেয়ে, কোন কিছুতেই আমরা মাইন্ড করি না। তাই কে কি বলতো এটাতে আমার মন খারাপ হতো, কিন্তু পাত্তা দিতাম না।
আমরা ভাড়া বাসায় থাকতাম ওসময়, চারতলা বাসা প্রত্যেক তলায় দুটো করে ইউনিট। আমরা থাকতাম তিনতলায়। নীচতলার মারুফ ভাই সারাদিন গেটের সামনে দাঁড়িয়ে থাকতো, বয়স বাইশ হবে তার তখন। যতবার তার সামনে দিয়ে যাই সে আমাকে স্যানিটারি ন্যাপকিন বলে ডাকে! আমি বুঝতাম না সেটা কি জিনিস? মফস্বল শহরে যে এটা খুব লজ্জার একটা জিনিস তা বুঝে আসছে আরো পরে। আমাদের প্রথম প্রথম তুলো দিয়েই কাজ চলে যেত। তবে মারুফ ভাই কখনও যৌনতার চাহনিতে তাকায় নি, আমরা মেয়েরা কিন্তু এটা ভালো বুঝি। বড় হওয়ার পরও তার সামনে আমার বারবার ওড়না ঠিক করতে হয় নি। এজন্য আমাকে স্যানিটারি ন্যাপকিন বলে ডাকার জন্যে মাফ করে দিয়েছি।
এরকম বুলিংইয়ের স্বীকার যেসব মেয়ে হয়, তারা যে সবসময় কালো হবে, এটা সত্য না। আমার গায়ের রঙ সাদা। আমি যে ফর্সা এটা বললাম না, কারণ আমার গায়ের রঙ এতটা সাদা যে আমি সাদা রঙের দেওয়ালের পাশে দাড়ালে আমাকে খুজে পাওয়া কঠিন। গার্লস স্কুল বলে, ছেলেদের দেখা পাওয়া যেত খালি কোচিং-এ। ক্লাস সেভেনে মেয়েদের মনে হাল্কা প্রেম প্রেম ভাব আশা শুরু করে, আমারও যে আসে নাই কথাটা ঠিক না! কিন্তু কোচিং এর ছেলেরা ততদিনে আমার নাম দিয়েছে হোয়াইটওয়াশ! একটা মেয়ে যার নাম হোয়াইট ওয়াশ বা স্যানিটারি ল্যাট্রিন/ন্যাপকিন তাকে কে ভালোবাসবে, বলেন?
ক্লাস নাইনে যখন পড়ি তখন কম্পিউটার চলে এসেছে অনেকের বাসায়। প্রথম প্রথম ফ্লপি ডিস্ক সহ এরপর সিডি প্লেয়ার। আমার বান্ধবী রুমানার বাবা কাস্টমসে কাজ করেন, বেজপাড়ায় চারতলা বাড়ি ওদের। সবাই অনেক পাত্তা দেয়, অনেক ছেলের সাথে বন্ধুত্ব ওর। ও কোথা থেকে জানি পর্ণের সিডি জোগাড় করলো। আমাকে বললো একেবারে দেশী জিনিস, দেখবি নাকি? আমি আকাশ থেকে পড়লাম, দেশী কিভাবে হলো? এটাও সম্ভব? আমি বলবো না যে আমার একটুও দেখতে ইচ্ছা হয় নি কিংবা এসব দেখলে পাপ হবে এরকম চিন্তা মনে এসেছে; বরং আসলেই আমার প্রবল ইচ্ছা হলো দেখার। ওটাই আমার জীবনের প্রথম পর্ণ দেখা, দেখতে দেখতে সিডি প্লেয়ার গেল আটকে, আর ঘুরেও না, খুলেও না। কি একটা অবস্থা!
পরদিন যখন স্কুলে গিয়েছি তখন সবাই যেন কেমন কেমন করে তাকায়। পরে জানতে পারলাম আমি না কি লেসবিয়ান! লেসবিয়ান বলেও যে কোন শব্দ আছে এটাও জেনেছি অনেক পরে! শিলা বললো, কাল নাকি আমি রুমানার বাসায় পর্ণ দেখতে গিয়ে রুমানকে চুমু খেতে ধরেছিলাম! ততদিনে আমি নিজের উপর নিজের বিশ্বাস হারিয়ে ফেলেছি! নিজেকেই জিজ্ঞাসা করলাম, আসলেই কি এরকম কিছু করলাম কি না! কোনভাবেই এরকম কিছু মনে পড়লো না। অথচ সারা স্কুলে এটা রটে গেল! ছোটবেলা থেকে বুলিড হওয়ার কারণেই আমি অনেক ভালো ফলাফল করতে পারি নি কখনও! ঐ যে মনে একটা চাপা কষ্ট আমাকে সবসময় তাড়িয়ে বেড়িয়েছে।
এই বুলিংয়ের রেশ কেটেছে ভার্সিটি লাইফে এসে। সেখানে আমার কোন বন্ধুও নেই, বান্ধবীও না। যা আছে তারা সব ক্লাসমেট। ভার্সিটির ক্লাসমেটরা আপনাকে পড়ালেখার জন্যে বা রূপের জন্যে বড়জোর হিংসা করতে পারে তবে বুলিং করতে আসবে না। গায়ের রঙ সাদা হওয়ায় কদরও কম না, আর কম কথা বলি বলে মানুষজন ভাবে বড়লোকের মেয়ে। সেসময় অনেক ছেলেই কাছে ঘেষতে চেয়েছে, দু’একবার ইচ্ছা হয় নি এমন না, তবে পাত্তা দিই নি। শুধু অনেক পড়াশুনা করেছি, এটুকুই।
এখন আমি জনস হপকিন্স -এ পড়াই। হ্যা, আমার হাজবেন্ড আছে, দুটো বাচ্চা আছে। এখন আমাকে আর কেউ স্যানিটারি ন্যাপকিন/ল্যাট্রিন, হোয়াইট ওয়াশ বা লেসবিয়ান বলে ডাকে না, অথবা হয়তো সে সাহসটা পায় না! কিন্তু যারা আমাকে ছোটবেলায় বুলিং করেছো, তাদের প্রতি আমার রাগ না থাকলেও মনের কষ্টটা কিন্তু এখনও যায়নি! তোমরা কি জানো এই গত বছর (২০২২ সালে) বাংলাদেশে ৩৪০ জন স্কুল পড়ুয়া ছাত্র/ছাত্রী সুইসাইড করেছে? তাদের মধ্যে যদি একজনও বুলিংয়ের স্বীকার হয়ে মারা যায়, এর দ্বায়ভার তোমারও! এই বুলিং কালচারটা তোমরাই সামনে এগিয়ে দিয়েছ!
আজ আমার কোন বন্ধু/বান্ধবী নেই। শুধুমাত্র ডোন্ট মাইন্ড ফ্যামিলির মেয়ে হওয়ার কারণেই আমি আজ হয়তো উতরে গেছি। সবাই কিন্তু উতরাতে পারে না!