“ভালোবাসি তিথি তোমাকে, ভালোবাসি আর্জেন্টিনাকে” -সৈনিক
ইশ্বরদি স্টেশনে এক পাশে দেখলাম লম্বা করে আর্জেন্টিনার পতাকা। আরেক পাশে ব্রাজিলের পতাকাও উড়ছে। যদিও বিশ্বকাপ শেষ । তবু পতাকা কেউই নামায়নি। বনির গায়েও দেখলাম আর্জেন্টিনার জার্সি। আমি সেদিকে তাকিয়ে বললাম , তিনদিন হয়ে গেলো বিশ্বকাপ শেষ , এখনো জার্সি পরেই আছিস? বনি আমার দিকে তাকিয়ে বললো, “এতোদিনের অপেক্ষার পর একটা দিন এসেছে, কি বলো এখনি খুলবো? অন্তত একমাস তো পরেই থাকব” আমি বনির দিকে তাকিয়ে থাকি। আজ ছয় বছর পর দেখা। এই রেলষ্টেশনে। সে যাবে খুলনা। আমি যাচ্ছি রাজশাহী। বনি বলে, “ভাইয়া মনে আছে, ২০১৪ তে আমরা একসাথে বিশ্বকাপ দেখলাম। আমি চাচার বাসায় বেড়াতে এসেছিলাম। এসে দেখি তোমাদের ফ্লাটেও বিশাল আর্জেন্টিনার পতাকা উড়ছে। আবার তিথি আপুও বড় একটা পতাকা ঝুলিয়ে দিয়েছে। আর্জেন্টিনার। পাশের ফ্লাটে অনিলদা আবার ব্রাজিলের পতাকা ঝুলিয়ে রেখেছে। বাবারে , মাঝে মাঝে যে তোমরা ঝগড়া লাগাতে। তুমি আর তিথি আপু ঐদিকে অনিলদা , বাচ্চু ভাইরা। আমার তখন অনেক বয়স কম…”
আমি চোখ বন্ধ করে ফেলি। সেই সন্ধ্যার কথা মনে হলো । ফাইনাল খেলা হবে সেদিন। আর্জেন্টিনা-জার্মানি। ছাদে দাড়িয়ে আছি আমি, একটূ দুরেই তিথি। ছাদে আর কেউ নেই। আমি তিথিকে হাতে ধরে কাছে আনি। সন্ধ্যার এই অদ্ভুত সুন্দর আলোতে তিথির ঠোঁট দুটো যেন সদ্য ফোটা গোলাপের নিস্পাপ পাপড়ির মতো মনে হচ্ছিলো। সেদিকে এগিয়ে যেতেই তিথি একটা ধাক্কা দিলো আমাকে।
-এই সাহস কত তোমার! কি হচ্ছে এগুলা!
-কি হচ্ছে মানে? আজ দেড় বছর ধরে চুপি চুপি প্রেম করি। একটা চুমু দিতেও পারবোনা।
তিথি খিল খিল করে হেসে উঠে বলে, “আহারে মাত্র দেড় বছর? তাতেই অস্থির?” আমি আরেকটু ঘনিষ্ঠ হতে চাইলাম তিথির । সে একটা মৃদ থাপ্পড়ও বসিয়ে দিলো। তারপর রহস্যময় গলায় বললো, “একটা শর্তে দিতে পারি। যদি আটাশ বছরের অপেক্ষা শেষ হয় তাহলে তোমারও দেড় বছরের অপেক্ষা শেষ হবে।
–এটা আবার কি জিনিস। আটাশ বছর?
-ওমা তুমি আর্জেন্টিনার সমর্থক হয়েও জানোনা?
-আজ আর্জেন্টিনা যদি জিতে যায় , তাহলে ধরো রাত তিনটা বা চারটা যাই বাজুক আমি ছাদে চলে আসবো, তুমিও আসবা । আমার জীবনের দ্বিতীয় চুমু্টা তুমিই পাবে।
-মানে কি? তুমি না বলো জীবনেও কারো ঘনিষ্ঠ হওনি। দ্বিতীয় চুমো মানে কি?
-কারন প্রথম চুমো আমি অবশ্যই মেসিকে দেবো। তোমাকে নয়…হাহাহাহা
আমি বিরবির করে বললাম, ধুত্তোরি মেসি…
বনি অবাক হয়ে বললো, কি হলো ভাইয়া ! মেসি মেসি করছো যে?
আমি হেসে দিলাম। বললাম, তিথিদের বাসায় যাস তুই?
-কি বলো আমার একটা মাত্র কাজিন। আর খুলনায় তো আমার আর কেউ নেই। প্রায়ই যাই।
-সে কেমন আছে?
-ভালোই তো দেখি।
-বিশ্বকাপ দেখে । এখনো আর্জেন্টিনার পাগল সাপোর্টার আছে?
-সেই …সেই সাপোর্টার এখনো সে। এদিকে রানা ভাইতো করে ব্রাজিল । এতো এতো ঝগড়া হয় ওদের মাঝে।
তিথির স্বামী ব্রাজিল সাপোর্টার! কেন যেন এই খবরটা দারুন রকমের আনন্দ দিলো আমাকে। হৃদয়ে একধরনের চঞ্চলতা অনুভব করে উঠলাম। এই ঝনঝন শব্দে পূর্ণ ইশ্বরদি স্টেশনে আমার কানের কাছে এসে কে যেন বলে দিলো, বেশ হয়ছে। বেশ হয়েছে।
-তাহলে স্বামীর সাথে প্রায়ই লেগে যায় না।।
-তাতো লাগেই। ব্রাজিল যেদিন ক্রোয়েশিয়ার কাছে হেরে বিদায় নিলো, সেদিন আবার আর্জেন্টিনা জিতে গেলো। তিথি আপু বিরানী রান্না করলো, ভোরের দিকে। রানা ভাই রাগ করে বিরানী মুখেও দিলোনা। আমি আর আপুই শুধু খেলাম।
-বেশ হয়েছে। বেশ।“ আমি হাত তালির মতো করে বলে উঠলাম। আমার উচ্ছাস বোধ হয় বনির চোখ এড়িয়ে গেলোনা। সে আগ্রহ নিয়ে আমার দিকে তাকিয়ে রইলো।
সেইরাতে খেলা শুরুতেই হিগুইন একটা সহজ গোল মিস করলো। আরেকটা দিলো বটে, কিন্তু সেটাও অফসাইড হয়ে গেলো। আমি তিথিকে মেসেজ দিলাম , “এই ম্যাচ আর্জেন্টিনাই জিতবে। ছাদে যাবার জন্য প্রস্তুত থাকো” তিথি উত্তর দিলো, “মেসির ঠোটে প্রথম চুমো দেবার জন্য বসে আছি। লাল লিপিষ্টিক ঠোঁটে লাগিয়ে চুমোটা দেবো।। তারপর তুমি পাবে…
আমি বিড়বিড় করে বলে উঠলাম, মেসির ঠোঁট এমন লাল কেন?
বনি বললো, কি বলো মেসির ঠোট লাল?” আমি দ্রুত জগতে ফিরে আসলাম।। বললাম,
– এই একমাস ছাড়া অন্য সময়েও কি খেলা নিয়ে- ব্রাজিল আর্জেন্টিনা নিয়ে ঝগড়া হয় তাদের?
-মাঝে মাঝেই হয়। তিথি আপু সেভেন আপ নিয়ে পঁচায়। আবার রানা ভাইও হ্যান্ড অফ গড নিয়েও…
এবার আর সেভাবে উচ্ছাস দেখাতে চাইলামনা। একটু গম্ভীর হয়ে বললাম, এসব তো মজা। দুষ্টুমি।
-কি জানি! মাঝে মাঝে দুষ্টুমির মাঝে আর থাকেনা। দুইজনের সাথে কথাও বন্ধ করে দেয়।
-বলিস কি!
-হুম। আরে তিথি আপুতো আর্জেন্টিনার পাগল সাপোর্টার। এতো সেন্টিমেন্টাল!…
সেদিনের ফাইনাল অতিরিক্ত সময়ে চলে গেলো। আমার মনে হলো টাইব্রেকারে গেলে রোমেরো জিতেয়ে দেবে আর্জেন্টিনাকে । গভীর আগ্রহ নিয়ে বসে আছি। জার্মান দলে মারিও গোটজে নেমেছে বদলি খেলোয়ার হিসাবে। আমি যখন টাইব্রেকার দেখার জন্য ।অপেক্ষায় আছি ঠিক তখনি ঠিক তখনি… মনে হলো বলটা যেন গোলবারের বদলে ঠিক আমার মুখ বরাবর ছুটে এসেছে…
-ভাইয়া কি হলো? শকড হবার মতো যে নড়ে উঠলে…
আমি বললাম, আরে না। আচ্ছা একটা কথা বলতো তিথির কি কখনো মনে হয় তার আর্জেন্টাইন সাপোর্টারকেই বিয়ে করা দরকার ছিলো?” বনি মুখে ব্যাকা একটা হাসি ঝুলিয়ে বললো, এমনতো কখনো বলেনি।
সেই ম্যাচ আর্জেন্টিনা হারার পরেও আমি ছাদে গিয়েছিলাম। তিথিকে মেসেজও দিয়েছিলাম, আমি ছাদে আছি। অপেক্ষা করছি” কোন ফিরতি মেসেজ এলোনা। আমার চোখে হঠাৎ পানি চলে আসলো। প্রিয় দলের পরাজয় নাকি প্রথম চুমো খাবার সম্ভবনা মিস হবার দুঃখে চোখে জল এসেছিলো ঠিক বুঝতে পারছিলামনা। কিন্তু ভোর পর্যন্ত আমি ছাদে ছিলাম মনে হচ্ছিলো ঠিক মেসির মতোই যন্ত্রনা আমার। মেসি কাপে চুমো দিতে পারলোনা। আর আমি…
বনি হঠাৎ আমার দিকে তাকিয়ে কোমল গলায় বলে উঠলো, ভাইয়া তোমাদের মাঝে যে প্রেম ছিলো, সেটা কিন্তু আমি জানি। তোমার ইয়ার লসটা না হলে…
অপরদিকের প্লাট ফর্মে তখন আমার রাজশাহীর ট্রেনটি এসে গেছে। বনিকে রেখে আমি সেই ট্রেনের দিকেই যেতে লাগলাম। আমি মনে পড়ছিলো সব কথা। তিথির বাবা খুলনায় পোস্টিং হলো, চলেও গেলো। রাজনীতি করার দায়ে আমার একবছর ইয়ার লস হয়ে গেলো। তিথির সাথে প্রায় প্রতিদিনই ঝগড়া হয়। আমি আমার সীমাবদ্ধতা বোঝাতে পারিনা তাকে। তারও হয়তো উপায় ছিলোনা আর। বাবা মা অস্থির করে মারছে। কোপা আমেরিকার যে ফাইনালে মেসি চোখ ভিজিয়ে কাদছিলো, সেই দিনেই তিথি মেসেজ দিলো…শেষ মেসেজ। “আজও মেসি হেরে গেলো। খুব কষ্ট হচ্ছে। জীবন এমনি। আমার বিয়ে ঠিক হয়ে গেছে আসিফ। আমার নাম্বার ঠিকানা সবকিছু চেঞ্জ হয়ে যাবে। আমাকে আর খুঁজো না কোথাও। পাবেওনা।“
আমার ট্রেনটি ছাড়েনি এখনো। আমি ভাবলাম বনি যেহেতু জানে সবকিছুই , তার কাছে একটা চিঠি লিখে দেই। একটা কাগজে লিখেও দিলাম। “দেখো মেসি এবার কত সুন্দর বিশ্বকাপে চুমু দিলো। শুধু আমার পাওনাটাই তুমি বুঝিয়ে দিলেনা আজো। তোমার ঠোটের অবহেলায় আমার ঠোট কখনো সিগ্রেট, কখনো গাজা, বাংলা মদ, ফেন্সিডিল কত কত জিনিস স্পর্শ করে এখন নির্জীব হয়ে গেছে। একবার তুমি এসে ছুঁয়ে দিলে হয়তো সে আবার জীবন ফেরত পেতো -আসিফ”
চিঠিটা দ্রুত লিখে ট্রেন থেকে নেমে বনিকে খুজতে লাগলাম। জানলাম খুলনার ট্রেন স্টেশন ছেড়ে চলে গেছে। একটা দীর্ঘশ্বাস ফেললাম। চিরকুটটা ছিড়ে ফেললাম।।ষ্টেশনে ঝুলানো আর্জেন্টিনার সাদা আকাশী পতাকার পাশ দিয়ে আকাশের দিকে তাকিয়ে বিড়বিড় করে বললাম, ভালোবাসি তিথি তোমাকে, ভালোবাসি আর্জেন্টিনাকে।