উড়োজাহাজ

১.
নিলীত সাহেব গত কুড়ি দিন হলো একই স্বপ্ন দেখছেন! হঠাৎ কেন, বা কিভাবে তার সাবকনশাস মাইন্ড এ ধরণের স্বপ্ন দেখাচ্ছে এ নিয়ে তিনি বিচলিত নন, কারণ তার সারাদিন এখন একটাই চিন্তা; তিনি যে করেই হোক উড়োজাহাজে চড়বেন-ই চড়বেন! তার ছোট চাকুরে, সরকারী কলেজের ল্যাব সহকারী। তেমন কোন উপরি ইনকাম নেই যে যা খুশি তাই খরচ করতে পারেন। মফস্বল শহরে এয়ারপোর্ট বলে কিছু নেই, প্লেন বলতে যেটুকু দেখা তা ঐ টিভিতে বা দূর আকাশে!

গেল বছর তাদের গ্রামের মফিজ দুবাই থেকে এসেছিল ছুটিতে, বড় ভালো ছেলে, তার কাছ থেকেই উড়োজাহাজের গল্প শোনা।। নিলীত সাহেবকে একটা ঘড়িও উপহার দিয়েছে, বাদামী রঙের বেল্ট, রঙটা যদিও তার পছন্দ হয় নি, তারপরও তিনি এটা পরে প্রতিদিন কলেজে আসেন।

– চাচা, আর বলবিন নে, ছোট বিলায় একটা গপ্প পড়িছিলাম, ‘মহাপতঙ্গ’! আসলিই দেখি মনি হয় তাই! সারা গায়ি চোখ! ভিতরে আবার বিভিন্ন কাইদা! কিলাস আছি আবার নানা রকম।
– পড়াশুনা ও করায়!
– আরি না চাচা, ফার্স্ট কিলাস, সেকন্ড কিলাস এইগুলা। ক্লাস অনুযাই বালো-বালো খাবার!
– ও আচ্ছা, বুঝতে পেরেছি। তা উড়োজাহাজ ঠিক কত উপরে উঠে বলতো?
– এই ধরেন হাজার পনেরো ফিট তো হবিই।
– তা বাবা দুবাই যেতে কেমন খরচ পাতি লাগে বলতে পারবা?
– চাচা, যাওয়াটা তো সমইস্যা না; সমইস্যা হচ্ছি বিসা ম্যানিজ করা, আর ওখানি অনিক কষ্ট! আপনি এই বুড়া বইসি গিয়া খামিখা কইষ্ট ক্যানি করবিন?
– আসলে ব্যপারটা তা না বাবা, আমার একটু উড়োজাহাজে চড়ার শখ হয়েছে তো; এই আর কি।
– ও এই কতা! তাইলি দুবাই যাতি হবি ক্যান? আমাদের দেশের মদ্যিও তো প্লিন চলাচল করে, আপনি চিটাগং, সিলেট, রাজশাহী, যশোর এসব জায়গাতিও তো প্লিনে করি যাতি পারেন, তাই না?

নিলীত সাহেবের বুদ্ধিটা পছন্দ হয়, মফিজ ছেলেটার নাম মফিজ হলেও মাথায় বুদ্ধি আছে। তার বাবা-মা তার প্রতি প্রচন্ড অবিচার করেছেন, নিলীত সাহেব চিন্তা করতে থাকেন ওর নাম কি হলে ভালো হতো! মফিজ এর সাথে মিল রেখে নামটা হলে ভালো হয়, যেমনঃ খবিজ, না এটার মানে ও তো ভালো কিছু না! শো-পিচ, এটা কেমন? এটা তো কারো নাম হতে পারে না! তাহলে কি? নিলীত সাহেবকে চিন্তিত দেখায়।

২.
নিলীত সাহেবের স্বপ্নটা অনেকটা এরকম, নিলীত সাহেব উড়োজাহাজের টিকেট কেটেছেন, ছাড়বে গুলিস্থান থেকে, তিনি ঠিক সময়েই পৌছে গেলেন। প্লেনের যাত্রী তিনজন, তিনি, মফিজ, আর একটা মেয়ে, যে কি না একটু পর পর তাকে জিজ্ঞাসা করছে কি খাবেন? নিলীত সাহেব মেয়েটার উপর বিরক্ত হতে গিয়েও পারছেন না, কারণ তিনি বিয়ে করলে তার এই বয়সী একটা মেয়ে থাকতো। একসময় তিনি তার মেয়ের নামও ঠিক করে রেখেছিলেন, নিয়তা। আচ্ছা এই মেয়েটার নাম কি? তার চোখ নেমপ্লেটের দিকে গেল, আরে এই মেয়েটার নাম ও তো নিয়তা! নিলীত সাহেব খুব অবাক হলেন, তার মনে হলো তিনি স্বপ্ন দেখছেন।

মফিজটা মেয়েটার দিকে বারবার আড়চোখে তাকাচ্ছে, তবে মেয়েটা তাকে পাত্তা দিচ্ছে না। মফিজ ছেলেটার প্রতি নিলীত সাহেবের একটা সফট কর্ণার তৈরী হয়েছে। আচ্ছা, নিয়তার সাথে মফিজের বিয়ে হলে ব্যাপারটা কেমন হবে? সে কি কথা বলে দেখবে? তবে মফিজের বুদ্ধি ভালো হলেও উচ্চারণ শুদ্ধ না, এই কারণে যদি মেয়েটা তাকে অপছন্দ করে তাহলে বলার কিছু নেই।

উড়োজাহাজ চলা শুরু করলো, মফিজ বলেছিল এটা প্রথমে দৌড়ায়, তারপর আস্তে আস্তে আকাশে উঠে। এখন উড়োজাহাজটা দৌড়ানো শুরু করেছে, রাস্তার উপর দিয়েই দৌড়াচ্ছে, নিলীত সাহেব ভয়ে ছিলেন, কোন ইলেকট্রিক তারের সাথে আবার না বেঁধে যায়, সেরকম কিছু হলো না। বিভিন্ন রাস্তা ঘুরে ঘুরে কলাবাগান পর্যন্ত এসে উড়োজাহাজটা থামলো, এখানে না কি তাদের স্টপেজ আছে! কলাবাগান কাউন্টারে তাদের কোন যাত্রী নেই, নিয়তা মেয়েটা আবার খাবার জন্যে পিড়াপিড়ি লাগাচ্ছে। নিলীত সাহেব বিরক্ত হয়ে ডালের মত কি জানি একটা বাটি হাতে নিলেন। উড়োজাহাজটা এবার আকাশে উড়া শুরু করেছে। নিলীত সাহেবের পাশের জানালাটা খোলা, তিনি কি মনে করে জানালা দিয়ে পা বের করে দিলেন, ঠিক এই সময় কিসের সাথে একটা বাড়ি খেয়ে উড়োজাহাজটা থেমে গেল! এই পর্যায়ে নিলীত সাহেবের প্রতিদিন ঘুম ভেঙ্গে যাচ্ছে!

এবার ঈদের ছুটিতে তিনি ঢাকায় এসেছেন, উড়োজাহাজের ব্যপারে টুকটাক খোঁজও নিয়েছেন। গুলিস্থান থেকে কোন উড়োজাহাজ ছাড়ে না, ঢাকায় পুরোনো এয়ারপোর্ট বলে একটা এলাকা আছে, তিনি ওখানেও খোঁজ নিয়েছিলেন, সেখান থেকেও না কি কোন প্লেন ছাড়ে না! তিনি প্রায় পত্র-পত্রিকায় পড়েন, ঢাকা শহর বসবাসের অযোগ্য হয়ে যাচ্ছে! অথচ, পুরোনো এয়ারপোর্ট এর মত বেশ কিছু এলাকা আছে যা কিনা ঢাকা শহরের মোট জমির পরিমাণের প্রায় অর্ধেক এবং এগুলো কোন কারন ছাড়াই খালি পড়ে রয়েছে! এই জমি গুলোকে সঠিক ভাবে ব্যবহার করলে হয়তো অন্যরকম কিছু হতো!

পরে যেটা জানলেন, উড়োজাহাজে উঠতে গেলে তাকে শাহাজালাল বিমানবন্দরে যেতে হবে। খোঁজ নিয়ে জানলেন, ঢাকা থেকে বাংলাদেশের বেশ কয়েক জায়গায় যাওয়া যায়। তার এক মামাতো ভাইয়ের বাড়ী ছিল যশোর। অনেকদিন কোন খোঁজ খবর নেওয়া হয় নি, সেখানে গেলে মন্দ হয় না।

টিকেটের দামের ব্যপারটা তার ঠিক মাথায় ঢুকলো না, একই সিটের দাম না কি সময় অনুযায়ী বিভিন্ন রকম! যদি আগে কাটা হয়, তাহলে না কি কম পড়ে, আবার যত পরে কাটা হবে টিকেটের দাম না কি তত বাড়বে! কি অদ্ভুত! শখের দাম মরা হাতি, আর এ তো মাত্র পাঁচ হাজার টাকা! এত বিচার বিবেচনা না করে, তিনি টিকেট করেই ফেললেন! মামাতো ভাইকেও জানালেন যে তিনি যাচ্ছেন, সে যেন তাকে এয়ারপোর্টে নিতে যায়।

৩.
শাহাজালাল বিমানবন্দরে বেশ ভীড়। তিনি লাগেজ ডেলিভারির রিলের সামনে অনেকক্ষণ দাঁড়িয়ে দেখলেন! উঠে পড়লে কেমন হয়? পরে ভাবলেন এই অপরাধে যদি তাকে প্লেনে উঠতে না দেওয়া হয়! এই রিস্ক নেওয়া যাবে না! নিলীত সাহেবের হাতে নভো এয়ারলায়েন্সের টিকেট। সকাল সাড়ে দশটার মত বাজে, নিলীত সাহেব উড়োজাহাজের সিঁড়ি বেয়ে উঠছেন। দরজার কাছে একটা মেয়ে দাঁড়িয়ে, শাড়ী পরা সুন্দর মেয়ের বয়সী মেয়ে! নিলীত সাহেব খুব অবাক হলেন, নেমপ্লেটে মেয়েটার নাম লেখা নিয়তা!

– মা ভালো আছ?
– জ্বী চাচা, আপনি ভালো আছেন?
– হ্যা, মফিজের সাথে যোগাযোগ হয়?

মেয়েটা এবার কোন উত্তর দিল না বরং তার দিকে চোখ পিট পিট করে তাকালো! মনে হয় মেয়েটার মফিজকে পছন্দ না! থাক না হয়, পছন্দ না হতেই পারে! উড়োজাহাজের মধ্যে ভালোই ঠান্ডা, এসি চলছে নিশ্চয়! সিটবেল্ট বাঁধার জন্য বলা হচ্ছে বারবার, সে বুঝতে পারছে না জিনিসটা কিভাবে বাঁধতে হয়। নিয়তা আবার এসছে সাহায্য করতে। এই মেয়ে নিশ্চিত পূর্বজন্মে নিলীত সাহেবেরই মেয়ে ছিল, না হলে এত খাতির করার কথা না!

প্রায় বিশ মিনিট হয়ে গেছে উড়োজাহাজ আকাশে, আর হয়তো কিছুক্ষণ পর নেমে যাবে। মফিজ বলেছিল, উড়োজাহাজের বাথরুম অনেক সুন্দর! তার একবার সেখান থেকে ঘুরে আসা উচিত! আবার কবে না কবে উঠবে উড়োজাহাজে! নিলীত সাহেব বাথরুমে ঢুকলেন, মেঝে এত চকচকে যেন তার মুখ দেখা যাচ্ছে। আয়নার দিকে তাকিয়ে একটু বিমর্ষ লাগলো তার, নাহ, বয়সটা অনেক বেড়ে গেছে! বের হওয়ার সময় তিনি আবিষ্কার করলেন, তিনি দরজা খুলতে পারছেন না! কেউ কি তাহলে বাইরে থেকে আটকে দিল! তিনি কি এখন দরজা ধাক্কাবেন! সবাই তাহলে বুঝে যাবে, এই লোক জীবনের প্রথম উড়োজাহাজে উঠেছে! একটা হাসির রোল উঠবে! তিনি দ্রুত চিন্তা করতে থাকেন কি করা যায়! কে জানি চাচা-চাচা বলে ডাকছে, নিয়তার গলা বলেই মনে হচ্ছে! মেয়েটা নিশ্চয় আগের জন্মে তার মেয়ে ছিল, না হলে তার এ বিপদের কথা সে কিভাবে টের পেল!

৪.
বিমানবন্দরের বাইরে সুকুমার দাঁড়িয়ে, সুকুমার তার মামাতো ভাই। কোথা থেকে জানি একটা ফুলের মালা জোগাড় করে এনেছে। নিলীত সাহেব সিনেমাতে দেখেছে জেলখানা থেকে বের হলে মানুষজন ফুলের মালা পরায়। এমনিতে তার মেজাজ খারাপ, এত টাকা দিয়ে টিকেট কাটার পরও পুরো সময়টা সে ঘুমিয়ে কাটিয়েছে! আচ্ছা, সিটবেল্টে কোন সমস্যা ছিল না তো, না হলে তার ঘুম পাবে কেন! নিয়তা মেয়েটা না ডাকলে আজ হয়তো তার ঘুম ভাঙতো না, নিশ্চয় আগের জন্মে সে তার মেয়ে ছিল! আধ-ঘন্টা জেগে থাকা কি খুব কঠিন কাজ ছিল, এসব চিন্তা করতে করতে সে সুকুমারের দিকে এগিয়ে যেতে থাকে। ফুলের মালাটা পরানো মাত্রই সে সুকুমারকে একটা কঠিন ঝাড়ি দিবে।।

আমার অন্য লেখা দেখুন

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here

Reviews

Popular Articles