আজ ভালবাসা দিবস

Rafin

১৪ই ফেব্রুয়ারি সন্ধ্যা ৭টা। লিয়ানা ড্রয়িং রুমে অস্থির হয়ে বসে আছে। কান খাড়া করে আছে কখন তালা খোলার শব্দ পাবে। গা গুলিয়ে বমি আসছে, কিন্তু উঠে বাথরুম পর্যন্ত যেতে ইচ্ছে করছে না। বাবা এখনও আসছে না কেন? খুব জরুরী কথা আছে আজ বাবার সাথে।

লিয়ানার বাবা জালাল সাহেব একটা বেসরকারি প্রতিষ্ঠানে একাউন্টেন্ট। একই যায়গায় আজ প্রায় ২০ বছর। বেতন খুব বেশি না হলেও সংসারে তারা মাত্র দুই জন। লিয়ানার মা মারা গেছে পনের বছর আগে। তখন লিয়ানার তিন কি সাড়ে তিন বছর বয়স। আবার চার ও হতে পারে। দিন তারিখ সাল তার খুব বেশি মনে থাকে না। বিয়ের পর তাই নিয়ে কি বিপাকেই না পড়তে হয়েছে। প্রথম বিবাহ বার্ষিকীর রাতে বাসায় ফিরে খাওয়ার টেবিলে অনেক খাবার দেখে বলেছিলেন , “ব্যাপার কি, আজ কি সুফিয়ারা আসবে?” লিয়ানার মা কোন উত্তর তো দেয়নি, সারা রাত তার সাথে কথা বলেনি। লিয়ানা হয়েছে ঠিক ওর মায়ের মত। দিন তারিখ সময় সব মনে রাখবে। স্মৃতি হিসেবে কিছু না কিছু উঠিয়ে রাখবে। জালাল সাহেব বিস্মৃতপ্রবন মানুষ, তাও অল্প কিছু স্মৃতি যখন তার বুকে চেপে বসে তার নিশ্বাস নিতে কষ্ট হয়। আর এতগুলো স্মৃতি এই ছোট্ট মেয়েটা যেভাবে আগলে রাখে পরে কিভাবে সামলাবে ভেবেই জালাল সাহেবের ভয় হয়।

গত বছর ইন্টার সেকেন্ড ইয়ারে উঠেছে লিয়ানা। বছর শুরুতেই জালাল সাহেব ওর বাসায় অংক করানোর জন্য বুয়েটের একটা ছেলে কে ঠিক করে দেন। সিভিল ইঞ্জিনিয়ারিং এ পাশ করে এখন বিদেশে যাওয়ার জন্য চেষ্টা করছে। জালাল সাহেবের অফিসের পিওন শরীফের ভাইপো। সেই সাথে করে এনেছিল।
– এইযে স্যার আমার ভাইপো সায়েম। বুঝলেন স্যার, খুবই ব্রিলিয়ান্ট ছেলে। অল্পের জন্য ফার্স্ট ক্লাস ফার্স্ট হয়নি। মামনি কিছুদিন এর কাছে অংক করুক, উন্নতি যদি না হয় আমার দুই গাল আর আপনার জুতা।

ছেলেটা চাচার মত এত বেশি কথা বলে না। জালাল সাহেবের বেশ পছন্দ হল। সাধাসিধে ছেলে। চেহারায় কোন পাঙ্কু ভাব নেই। পাঙ্কু ছেলে তার দু চোখের বিষ।

জানুয়ারি মাসের ১০ তারিখেই লিয়ানাকে পড়ানো শুরু করে সায়েম। আজিমপুরের পুরানো একটা দোতলা বাড়ির ঝুল বারান্দায় লিয়ানার পড়ার টেবিল। দুপুর তিনটা থেকে এক ঘণ্টা অংক করায় সপ্তাহে চারদিন। অংক জিনিসটা যে একেবারে ম্যাড়ম্যাড়ে বিরক্তিকর না লিয়ানা প্রথমবার বুঝতে পারে সায়েমের কাছ থেকে। দেখতে খুব সাধাসিধে মানুষটার এত স্মার্ট ব্যক্তিত্ব লিয়ানাকে খুব অবাক করে। এত সুন্দর করে গুছিয়ে কথা বলে, কথা বলার সময় লিয়ানা শুধু তাকিয়ে থাকে। সায়েমকে যে ওর একটু একটু ভাল লাগে সেটা লিয়ানা বলেছিল ওর বান্ধবী ইরিন কে। শুনেই চোখ কপালে তুলে ইরিন বলেছিল, “কে? ঐ সুবোধ বালক? সেদিন তোদের বাসা থেকে যে বের হচ্ছিল যখন তোদের বাসায় গেলাম?
-ইন্টারেন্টিং আছে। কথা না বললে বুঝবি না
-তা তো আছেই। নাহলে তোর মত নিরামিষ একটা মানুষ কেন আমিষ খাওয়ার জন্য হঠাত ব্যাকুল হয়ে পড়ল।
-আমি নিরামিষ?
-১৮ বছরের একটা মেয়ে যদি বলে তার বাম হাতের মধ্যমা তাকে কোনদিন আদর করেনি তাকে নিরামিষ ছাড়া কি বলব?
-আমি ঠিকই আছি। তোরই একটু বেশি জ্বালাপোড়া। তোকে কি জন্য বললাম, আর তুই কি সব বলে যাচ্ছিস? কোনদিন আমার কান পচে যাবে এইসব শুনে।
-শোন ভাল যখন লাগে বেশি ভণিতা না করে, সরাসরি বলে ফেল। খালি বাসায় পাচ্ছিস ইচ্ছে মত এনজয় কর।
-আবার সেই একই দিকে যাচ্ছে তোর কথা। আর মোটেও খালি বাসা না। আমাদের বুয়া থাকে বাসায়।
-বুয়াকে কিভাবে খসাতে হবে সেটা আমার থেকে শোন…

লিয়ানা দীর্ঘশ্বাস ফেলে। এই মেয়েটার মাথায় ঐ এক জিনিস ছাড়া আর কিছু নাই।

ইরিনের প্ররোচনায় গত বছর ঠিক এইদিনেই সায়েমকে একটা খামে করে একটা চিঠি লিখে দিয়েছিল লিয়ানা। এক লাইনের চিঠি।

“আমি যে আপনার প্রেমে হাবুডুবু খেতে খেতে ডুবেই গেলাম, তা বুঝেন না?“

উত্তর এসেছিল ২ ঘণ্টা পর মেসেঞ্জারে।
-কি করব, এর আগে কাউকে আমার প্রেমে হাবুডুবু খেতে দেখিনি যে
-এইটুকু যে বোঝে না তাকে বুয়েটে চান্স দেওয়া উচিৎ হয়নি
-বুয়েটে ইঞ্জিনিয়ারিং পড়ায়, প্রেম না
-আপনাকে প্রেম তাহলে আমি পড়াব
-তোমাকে ম্যাথ পড়ানোর জন্য বেতন তো আমি নিচ্ছি
-ম্যাথে আমি পাশ করে যাব। আপনি প্রেমে পাশ করেবেন কিনা দেখার বিষয়। বেসিক যা দূর্বল আপনার

এই চ্যাটের স্ক্রিনশট এখনও লিয়ানার মোবাইলে আছে। সেই চিঠিটাও সায়েমের কাছ থেকে চেয়ে নিয়েছিল। আলমারির ড্রয়ারে এখনও যত্ন করে রাখা আছে।
সবকিছুর প্রথমবারের স্মৃতি লিয়ানার মনে থাকে। দিন তারিখ সময় সহ।

সেই প্রথমবার যখন সায়েম ওর হাত ধরেছিল ধানমণ্ডি লেকের পাশে হাঁটতে হাঁটতে। দুইজনই দুই দিকে তাকিয়ে হাঁটছিল। ২রা এপ্রিল, বিকাল ৪টার দিক।
প্রথম যেবার রিকশায় লিয়ানার সাথে তর্ক করতে করতে ওর বাম গালে চুমু খেয়েছিল সায়েম। সব মনে আছে লিয়ানার স্পষ্ট। ৫ই মে, সন্ধ্যা ৭ টা। তর্ক ভুলে দুজনেই মুখে চাপা হাসি নিয়ে একে অপরের দিকে তাকিয়েছিল কয়েক সেকেন্ড।

গত বছর ১৭ই জুলাই ছিল ওদের পরিচয়ের পর সায়েমের প্রথম জন্মদিন। ঠিক রাত ১২টায় লিয়ানা মেসেঞ্জারে লিখেছিল হ্যাপি বার্থডে স্যার।
-ধন্যবাদ। কর কি?
-দাড়াও ছবি পাঠাচ্ছি

হ্যাপি বার্থডে সায়েম লেখা কেকে মোমবাতি জ্বালিয়ে ছবি তুলে পাঠিয়েছিল লিয়ানা। ছবি দেখে সায়েম বলেছিল, “ ছবি ঠিক আছে। কিন্তু পারফেক্ট না।”
-মানে? এই রাতে এত কষ্ট করে শাড়ি পরলাম তোমার জন্য।
-মানে জন্মদিনের ছবি জন্মদিনের পোশাকে হলে ঠিক হত।
-কুত্তা। আর আমার তো জন্মদিন না। জন্মদিন তোমার।
-তাহলে ওইটাই আমার জন্মদিনের গিফট।
-খুব লজ্জা লাগবে আমার।
-খুব ভাল লাগবে আমার।
-আচ্ছা একটাই কিন্তু

ছবি দেখে সায়েম লিখেছিল “আজ রাতে আমি মারাই যাব”

জুন মাসের ১৫ তারিখ দুজন কাক ভেজা হয়ে রিকশায় বসুন্ধরা সিটি থেকে লিয়ানাদের বাসার দিকে যেতে সায়েম ওকে জড়িয়ে ধরেছিল। ওর হাত দুটো একে বেঁকে লিয়ানার শরীর বেয়ে উঠছিল আর লিয়ানা কেমন যেন একটা ঘোরের মধ্যে চলে যাচ্ছিল। সারা শরীর অবশ হয়ে গিয়েছিল যেন। শুধু মাথাটা কাত করে সায়েমের কাঁধে রাখতে পেরেছিল। সায়েমের শ্বাস যখন ওর গালে এসে পড়ল তখন ঠোট দুটো এগিয়ে দেওয়ার মতও গায়ে শক্তি ছিল না। সায়েমই এগিয়ে এসে ওর ঠোট দুটো গ্রাস করেছিল। সারা রাস্তা আর কোন কথা হয়নি তাদের। কাক ভেজা শরীরটা ভিতর থেকে ভিজে গিয়েছিল সেদিন।

বাসায় ফিরে লিয়ানা লিখেছিল, “তুমি আমায় যাদু করেছ”
-কেন?
-আমার শরীর মন তোমার জন্য পাগল হয়ে উঠছে শুধু
-আমাদের দুজন দুজনকে আরও কাছ থেকে পাওয়ার সময় হয়েছে

লিয়ানা অনেকক্ষণ কিছু লিখছে না দেখে সায়েম জিজ্ঞেস করেছিল, “কি হল, কিছু বললে না যে?”
-বললে তুমি আমাকে বেহায়া ভাববে
-লাজুক মেয়েকে বেহায়ারূপে পাওয়ার মাঝে আলাদে একটা ব্যাপার আছে।
-কিন্তু আমার খুব ভয় লাগে, কিছু যদি হয়?
-কোন ভয় নেই, আমি তো আছি তোমার সাথে

জুলাইয়ের ৩ তারিখ সায়েম ওকে নিয়ে গিয়েছিল ওর ফ্ল্যাটে। চারতলা বাড়ির একদম উপড়ের তলায় ফ্ল্যাট। ঈদের ছুটিতে বাকি সবাই তখন ঢাকার বাইরে। সায়েম থেকে গিয়েছিল লিয়ানার জন্য। ঈদের দিন দুপুরে সেই অগোছালো মেসের বিছানায় নতুন এক জগত আবিষ্কার করেছিল লিয়ানা। একরাশ ভাল লাগা, ভয় আর উত্তেজনা নিয়ে শুধু সায়েমকে দেখেছিল সেদিন। সহজ সরল সায়েমের মাঝে ধীরে ধীরে পৌরুষ জেগে ওঠা দেখতে ভাল লাগছিল। লিয়ানার পুরো শরীরটাকে ক্যানভাস বানিয়ে ঠোটের তুলিতে রং বেরং এর কত ছবি এঁকেছিল সেদিন সায়েম।

ধীরে ধীরে যখন ভয় কেটে গিয়েছিল, তখন ওরা সেই ফ্ল্যাটে মোটামুটি নিয়মিত। ঐ মেসের বিছানার ময়লা চাদরে শুয়েই কত না স্বপ্ন বুনতো। কত নতুনভাবে নিজেদের আবিষ্কার করেছিল। প্রতিবার সায়েমকে আরও গভীরে পাওয়ার জন্য ব্যাকুল হয়ে উঠত লিয়ানা। সেই ব্যাকুলতাই হয়ত সায়েমকে এমনভাবে স্পর্শ করেছিল যে একদিন লিয়ানার কানে কানে বলেছিল, “আজ একদম নগ্নভাবে তোমাকে স্পর্শ করতে চাই”
-স্পর্শ করার সময় মনে হয় গায়ে কিছু রাখতে দাও তুমি?

লিয়ানা বোঝেনি দেখে শুধু বালিশের পাশে রাখা কনডমের প্যাকেটটা টোকা মেরে মেঝেতে ফেলে দিয়েছিল। বিস্ফারিত চোখে সায়েমের দিকে তাকিয়ে বুঝেছিল আজ থামার মত অবস্থায় নাই ও। অস্ফুট স্বরে শুধু একবার বলেছিল, “আমার ভয় করছে সায়েম”
ততক্ষণে খোলা চামড়ার স্পর্শ ওর ভিতরটা জাগিয়ে তুলতে শুরু করেছে। কানের কাছে সায়েমের গাঢ় শ্বাস প্রশ্বাসের সাথে শুনতে পেল, “ কোন ভয় নেই, আমি সময়মত বাইরে বের করে নেব”

নভেম্বরের ২৭ তারিখ যখন সায়েমের মাস্টার্সের রিসার্চ প্রপোজাল রিজেক্ট হয়ে যায়, তখন খুব ভেঙ্গে পড়েছিল ও। বেচারার ঐ অবস্থা দেখে খুব কষ্ট হয়েছিল লিয়ানার। সায়েমের মাথায় হাত বুলিয়ে বলেছিল, “এইবার হয়নি, পরের সেমিস্টারে দেখ। নাহলে ভার্সিটির কি অভাব আছে?”
-কিন্তু এই টপিকটা আমার রিসার্চ ইন্টারেস্ট এর যায়গা। আমি এটাতেই কাজ করতে চাই। ও তুমি বুঝবে না। ক্লাসমেটদের সবারই কিছু না কিছু ব্যাবস্থা হয়ে যাচ্ছে। আমার পক্ষে পুরো সেমিস্টার বসে থাকা সম্ভব না। বাসার খরচ ও তো আমারই চালাতে হয়। ইউ এস এ যাওয়ার ইনিশিয়াল খরচ বাবদ ৩ লাখের মত টাকা জমানো আছে। সেটা যদি ৬ মাস ঢাকায় বসে থাকি সব খরচ হয়ে যাবে। একটা ফান্ডিং আমার খুব দরকার ছিল আমার এখন।

সায়েমকে জড়িয়ে ধরে লিয়ানা বলেছিল, “বাবার অনেক টাকা থাকলে আমি ঠিকি তোমার জন্য একটা ব্যবস্থা করে ফেলতাম।”
-সেটা যখন নাই, তাহলে আর সেকথা উঠিয়ে লাভ কি?
সায়েমের কথায় বিরক্তি সেদিন লিয়ানাকে অনেক অবাক করেছিল।

ক্যারিয়ারের চিন্তায় সায়েম তখন পাগল প্রায়। ওরা তেমন কোথাও ঘুরতে যেত না, মেসেঞ্জারেও আগের মত দুষ্টামি করত না। মাঝে মাঝে শুধু ওর ফ্ল্যাটে দেখা হত। তখন ওকে খুব অচেনা লাগত। লিয়ানা রোজ ঘুমাতে যাওয়ার আগে ভাবত কাল সকালে উঠে হয়ত দেখবে সায়েমের রিসার্চ প্রপোজাল একসেপ্ট হয়ে গেছে। সে মিষ্টি নিয়ে ওদের ড্রয়িংরুমে বসে আছে। বাবা কিছুই বুঝতে পারছে না তার মেয়ের গৃহশিক্ষক কেন আমেরিকা যাওয়ার খুশিতে তার বাড়ি মিষ্টি নিয়ে এসেছে। হবে নিশ্চয়ই একদিন। লিয়ানা দীর্ঘস্বাশ ফেলে ঘুমিয়ে পড়ত।

জানুয়ারি মাসের ৭ তারিখ সায়েম লিয়ানাকে ফোন করে বলে ও গ্রামের বাড়ি যাচ্ছে। ১০ তারিখ ওদের পরিচয়ের এক বছর হবে। লিয়ানা ভেবেছিল ঐদিন সায়েমের জন্য রান্না করে নিয়ে যাবে ওর ফ্ল্যাটে। সারাদিন ওর সাথে থাকবে। সন্ধ্যাবেলা বাবা আসার আগে ফিরতে পারলেই হবে। কিন্তু কিছুই হবে না দেখে হতাশ গলায় জিজ্ঞেস করল, “হঠাত?”
-বাবা খবর পাঠিয়েছে। তার শরীর বেশি ভাল না।
-সাবধানে যেও। কখন বের হবে?
-এইতো এখন
-পৌঁছে ফোন দিও
-আমাদের গ্রামে তো নেটওয়ার্ক নাই
-তাহলে আমাদের কথা কিভাবে হবে
-সদরে নেটওয়ার্ক আছে। আমি সদরে গেলে তোমাকে ফোন দেব। তবে আমাদের বাড়ি থেকে ভ্যানে করে যেতেই চল্লিশ মিনিট লাগে। রোজ হয়ত কথা হবে না।

এরপর আর সায়েমের সাথে কথা হয়নি। প্রতিদিন লিয়ানা ফোন হাতে নিয়ে বসে থাকত যদি সায়েম কল দিয়ে ওকে না পায়। বার বার মেসেঞ্জার চেক করত। ভাবত ওর বাবার কিছু হল না তো। আঠারো দিন পর ২৫ তারিখ ইনবক্সে সায়েমের একটা ম্যাসেজ পেল।

“লিয়ানা, আমাকে ক্ষমা করবে না জানি। কিন্তু আমার আসলেই কিছু করার ছিল না। আমার ফুপাতো বোনের সাথে বাবা আমার বিয়ে অনেক আগে ঠিক করে রেখেছিল। এইবার বাসায় আসার পর বাবা আমাকে জানায়। আজকালকার যুগে এইসব ইমোশনকে কেউ পাত্তা দেয়না জানি, কিন্তু যে বাবা তার সারাজীবনের পরিশ্রমের জমানো টাকা দিয়ে আমাকে এই পর্যায়ে এনেছে তার কথা আমি ফেলতে পারিনি। আমাদের আর দেখা হবে না। কথাও হবে না। পারলে আমাকে ভুলে যেও।”

একবার পড়েই মুছে ফেলেছিল লিয়ানা ম্যাসেজটা। দেয়ালে পিঠ ঠেকিয়ে ধপ করে বসে পড়েছিল মেঝেতে। মনে হচ্ছিল এরকম কোন ম্যাসেজই হয়ত আসেনি। হয়ত ওর মনের ভুল ছিল সব। কি করবে কিছুই বুঝে উঠতে পারছিল না। মনে হচ্ছিল শ্বাস নিতে পারছে না। কিছুক্ষণ পর যখন একটু স্বাভাবিক হল, সায়েমকে ম্যাসেজ পাঠানোর চেষ্টা করল প্রথমে। কিন্তু সায়েম ওর আইডি ব্লক করে রেখেছে। কোনও উপায় না পেয়ে সায়েমের ক্লাসমেট শুভকে ইনবক্সে ম্যাসেজ দিল যেন সে সায়েমকে তার সাথে যোগাযোগ করতে বলে।

দুইদিন পরও যখন কোন ফোন পেল না লিয়ানার তখন মাথা খারাপের মত অবস্থা। সারাদিন ঘরে বিছানায় শুয়ে থাকত। এর মাঝে লিয়ানার শরীরও খুব খারাপ হল। সারাদিন বমি বমি ভাব। উঠে দাঁড়ালেই মনে হত সারা ঘর দুলছে। ২৭ তারিখ সন্ধ্যায় একটা ফোন পেল। নম্বর অচেনা, তারপর লিয়ানা রিসিভ করল। ওপাশ থেকে অচেনা গলায় বলল, “কে? লিয়ানা?”
-জ্বি, আপনি কে?
-আমি ফয়সাল, সায়েমের বন্ধু। তুমি হয়ত আমাকে চিনবে না।
-না ভাইয়া, আমি আপনাকে চিনি। আমি সায়েমের পোস্টে আপনার কমেন্ট দেখেছি। সায়েমের সাথে কি রিসেন্টলি আপনার যোগাযোগ হয়েছে?
-আমি শুভর কাছে সব শুনলাম। তুমি ওকে ম্যাসেজ পাঠিয়েছিলে যেন সায়েমের সাথে যোগাযোগ করে। আসলে সবশুনে আমার মনে হয়েছে ব্যাপারটা ঠিক হয়নি তোমার সাথে। এইজন্য ভাবলাম সত্যটা তোমার জানা উচিৎ।
-কি সত্য?
-সায়েমের ফুপাত বোনের সাথে বিয়ে আসলে পনের দিন আগে ঠিক হয়নি। হয়েছে দুই মাস আগে। ওর ফুপুরা ইউ এস এ তে সেটেল্ড। আমি যতদূর জানি ওর মাস্টার্সের পড়ার টাকা তারাই দিচ্ছে।
-এতদিন ও শুধু অভিনয় করে গেছে?
-আমি তো সেটা বলতে পারব না। হয়ত ও তোমাকে ভালোবাসতো। কিন্তু ওর ক্যারিয়ারের প্রতি অবসেশনের কাছে ভালবাসা হেরে গেছে।

আর কিছু শুনতে ইচ্ছে করছিল না লিয়ানার। কিছু না বলেই কেটে দিয়েছিল।

চারদিন কলেজে যায়নি দেখে ইরিন ওকে দেখতে এলো। লিয়ানা তখন পাতলা একটা কাঁথা গায়ে দিয়ে শুয়ে আছে। ইরিন এসেই ওর পাশে পা ছড়িয়ে বসে বলল, “দুই দিন জামাই নাই আর তুই বিছানায় পড়ে গেলি?”
-মাথা ঘোরাটা কমছে না। কিছু খেতে পারি না, যা দেখি খালি বমি আসে?
-জন্ডিস বাধালি নাকি?
-জানি না? বাবাকে এখনও বলিনি। পিরিয়ডও হয়নি এইবার
-মানে? কতদিন হল?
-আটদিন আগে হওয়ার কথা ছিল
-তোরা প্রোটেকশন তো ইউজ করতি, নাকি?
-শুরুর দিকে। পরে করতাম না
-ও মাই গড। তুই এত বোকা কেন? এই ভুল কেউ করে?
-এখন কি হবে
-আচ্ছা শোন। আমরা যা ভাবছি তা তো নাও হতে পারে।
-তোর আপু গাইনি ডাক্তার না? তার সাথে কথা বলিয়ে দিতে পারবি?
-আপু তো এখন চেম্বারে। রাতে বাসায় ফিরলে আমিই তোকে ফোন দেব।
-টেস্ট স্ট্রিপ দিয়ে টেস্ট করে দেখবি?
-সেটা কিভাবে করে?
-আমি ঠিক জানি না। তুই বরং আগে আপুর সাথেই কথা বল।
-সায়েমকে জানিয়েছিস? ও ফিরবে কবে?
-ফিরবে না
ইরিনের মাথায় যেন আকাশ ভেঙ্গে পড়ল।
-ফিরবে না মানে?
-মানে সায়েমের সাথে এখন আমার কিছু নাই
-নাই বললেই হয়ে গেল। এত কিছু হয়ে গেল, তুই ওকে একবার জানা
-ওর সাথে যোগাযোগ করার কোন উপায় আমার নেই
-আচ্ছা আগে আপু কি বলে শোন

রাত সাড়ে নয়টায় ইরিনের বোনের সাথে যখন কথা হল, সব শুনে তাকে বেশ চিন্তিতই মনে হল। শুধু বলল, “পিরিয়ড তো অনেক কারণেই ইরেগুলার হতে পারে। তবে তুমি যেহেতু কনসিভ এর ভয় করছ আমি তোমাকে একটা ব্লাড টেস্ট লিখে দিচ্ছি ওটা কাল করাও। পরশু রিপোর্ট এর ছবি তুলে আমাকে পাঠিয়ো।”

ফেব্রুয়ারি মাসের এক তারিখ রিপোর্ট দেখে ইরিনের ফোন থেকেই আপু ফোন দিল। “লিয়ানা?”
-জ্বি আপু
-তোমার রিপোর্ট দেখলাম। আনফরচুনেটলি তোমার কনসিভ করেছে।
-এখন কি করব আপু।
-ভেঙ্গে পড় না। ভুল তো যে কারও হতে পারে। আমার মনে হয় এই অবস্থায় তোমার এবর্ট করা উচিৎ। তুমি বাসায় বড় কারও সাথে বিষয়টা নিয়ে আলাপ কর। যা হয়ে গেছে তা তো গেছেই। এটা তাড়াতাড়ি একটা সমাধান করে ফেলাই ভাল। দেরি করনা। কি সিদ্ধান্ত নাও তোমরা তা আমাকে জানিয়ো।

এতবড় দুঃসংবাদ পেয়েও লিয়ানার কেন যেন একটু ভয় লাগেনি সেদিন। সায়েমের উপরও একটুও রাগ ওঠেনি। শুধু বাবার জন্য খুব খারাপ লাগছিল। এতবড় দূর্ঘটনা তার জীবনে ঘটে যাবে এটা হয়তো বাবা কখনো দুঃস্বপ্নেও দেখেনি। বাবাকে কিভাবে বলবে সেটাও মাথায় আসছিল না। গত তের দিন শুধু এটাই ভেবেছে লিয়ানা। একবার ভেবেছে ছাদে উঠে লাফ দিলেই সব ঝামেলা মিটে যায়। কিন্তু তাতেও কি বাবা কষ্ট কম পাবে?

আজ লিয়ানা অনেক সাহস সঞ্চয় করে ঠিক করেছে বাবাকে সব খুলে বলবে। বসে বসে এতকিছু ভাবতে ভাবতে হঠাত তালা খোলার শব্দ পেল। জালাল সাহেব ঘরে ঢুকে লিয়ানাকে দরজার সামনে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে খুব অবাক হলেন, “কিরে তোর চেহারা এমন দেখাচ্ছে কেন? শরীর খারাপ নাকি রে?”
-বাবা, একটা কথা বলব?
-কি কথা? বল।
-আমি যদি খুব বড় কোন ভুল করি, তারপরও তুমি আমাকে ক্ষমা করবে?
বলতে যেয়ে লিয়ানা ফুঁপিয়ে কেঁদে উঠল। দৌড়ে যেয়ে বাবার বুকে মাথা টা রেখে বাবাকে জড়িয়ে ধরল।
জালাল সাহেব মেয়ের মাথায় হাত রেখে বললেন, “ভুল তো সবারই হয় রে মা। কি হয়েছে বল আমাকে”
-আমি বলতে পারছি না বাবা। আমার খুব ভয় করছে
জালাল সাহেব মেয়েকে শক্ত করে জড়িয়ে ধরে বললেন, “কোনও ভয় নেই, আমি তো আছি তোর সাথে”

কথাটা লিয়ানার খুব পরিচিত মনে হল। কিন্তু আজকে কেন যেন অন্যরকম স্বস্তি লাগল। বাবা তাকে সেই ছোটবেলার মত জড়িয়ে ধরে আছে। ছোটবেলায় যখন বিকট স্বরে বাজ পড়ত, লিয়ানা দৌড়ে বাবার কাছে গেলে বাবা এভাবে জড়িয়ে ধরত। তখন মনে হত আর কোন ভয় নেই। অনেকদিন পর আজ আবার সেরকম মনে হল। পৃথিবীর কোন বিপদই মনে হল তাকে বাবার কোলে ছুতে পারবে না। আজকের দিনটা মনে রাখা দরকার। লিয়ানার মনে পড়ল আজ ১৪ই ফেব্রুয়ারি।

এই অকৃত্রিম নিখাদ ভালবাসাগুলোকে উদযাপনের জন্য আজ ভালবাসা দিবস।

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here

Reviews

Popular Articles