এই, তাড়াতাড়ি ফিরো!

sabbiRif

১.
আজ সোমবার। সাহেদ সাহেব ভরদুপুরে বারান্দায় বসে রোদ পোহাচ্ছে! মানুষ এই গরমে হয় ভোরবেলায় সূর্যস্নান করে কিংবা বৃষ্টি হলে চেয়ার টেনে বারান্দায় বসে বৃষ্টি দেখে; সাহেদ সাহেবের আসল উদ্দেশ্য কি বোঝা গেল না! ভদ্রলোক বেবি বুমারস গোত্রের, মাঝারি গড়নের এবং ব্রাউনিশ কমপ্লেকশন; এক কথায় এভারেজ টাইপের লোক। জীবনে বলার মতো এমন কিছুই করেননি। কিছুদিন হল চাকুরী থেকে অবসর নিয়েছে; স্ত্রী মারা গেছে বছর পাঁচেক। একটাই ছেলে, আমেরিকায় থাকে। তিনি ছেলেকে আমেরিকায় পাঠিয়েছেন ঘুষের পয়সায়, এতে তার কোন লজ্জা নেই! তিনি ঘুষ না খেলে অন্য কেউ খেত এটাই তার যুক্তি।

সকালে বুয়া এসে রান্না করে দিয়ে যায় তবে টিপিক্যাল বুয়াদের মত খ্যাচ-খ্যাচ করার অভ্যাস তার নেই। আজ সকালে বুয়া বললো,
-খালুজান কাল আসতে পারবো না।
-কেন? কি কাজ?
-কাল একটা লটারির টিকেটের ড্র আছে, ৪০ লক্ষ টাকা পুরষ্কার! যদি লাইগা টাইপ ঘটনা যদি ঘটে, তখন একটা মান-ইজ্জতের সাওয়াল হয়ে দাঁড়াবে!
– তা সেই টাকা দিয়ে কি করবা?
– কিং খানকে একদিনের জন্যে ভাড়া করে নিয়ে আসবো, তারপর বলবো, এই শালা নাচ! আমি ইলিয়াস কাঞ্চনের মতো বিন বাজাচ্ছি আর কিং খান কোমর বাকায় নাচতেছে, কেমন হবে বলেন তো খালুজান?

বাজারটা সাহেদ সাহেব নিজেই করেন। আজ রাতে তিনি বাজারে যাবেন বলে ঠিক করেছেন, রাতের দিকে বাজারে জিনিসপত্রের দাম কমতে থাকে। দরদামও করা যায় অনেকটা মানুষের মনকষ্টের মত! সময়ের সাথে সাথে যেমনটা কষ্ট কমতে থাকে; সে মরা বাড়ী হোক কিংবা প্রেমিকা ছেড়ে গেলেই হোক! বাসা থেকে যদিও হেটে যাওয়া যায়, তারপরও সাহেদ সাহেব রিক্সা নেবেন বাজারে যাওয়ার সময়। রিক্সা ভাড়া দশ টাকা, এর কমও না বেশীও না তবে তিনি আজ একটা এক্সপেরিমেন্ট করবেন। তার ধারণা সানগ্লাস পরে রিক্সার ভাড়া ঠিক করলে রিক্সাওয়ালা বেশী ভাড়া চায়! আহা, তখনতো রাত, রিক্সাওয়ালা ভাববে তিনি অন্ধ! এই ফ্যাক্টরকে ইনফ্লুয়েন্স হিসেবে কাজ করতে দেওয়া যাবে না। এই প্ল্যান আজকের মতো বাদ!

আজ হঠাৎ সরষে ইলিশ খাওয়ার ইচ্ছে হচ্ছে। বরং তিনি বাজারে গিয়ে মাছওলার সাথে কি কি বলবেন মনে মনে ঠিক করলেন, সিনটা এরকম –
– How much? (সাহেদ)
– ইলিশ মাছ (মাছ ওয়ালা)
– OK
– ও আমার ছোট ভাই, কুদ্দুস!
এটা পুরানো জোক, তবে কখনও এপ্ল্যাই করা হয়নি! আজকে বলে দেখা যেতে পারে! এর বেশী অবশ্য সে ইংলিশ পারে না! ছেলেকে জিআরই-র পড়া ধরতে ধরতে তিনি অবশ্য অনেক শব্দ শিখেছেন, কিন্তু বাক্য গঠন করতে পারেন না! আচ্ছা, ফিলিপ্স বাতি কি এখনো বাজারে পাওয়া যায়? “মাছের রাজা ইলিশ, আর বাতির রাজা ফিলিপ্স” এর ইংরেজি কি?

আত্মীয়-স্বজন বলতে এই শহরে তার কেউ নেই। শুধু মতিন নামে তার এক ভাতিজা আছে যে প্রতি সোমবার তার সাথে দেখা করতে আসে, সে তাকে আঙ্কেল বলে ডাকে। সাহেদ সাহেবের আঙ্কেল শব্দটা পছন্দ না, কেমন একটা দূরের মানুষ মনে হয়; তবে মতিনকে এসব বলে লাভ নেই! মতিন এলে তারা দুজন মিলে বাজারে যাবে বরং, এরপর কাঠের চুলায় রান্না বসবে। সেই রান্না হবে অনেক আয়োজন করে, টোনা-টুনি আসবে গুড় নিয়ে, শাঁকচুন্নি এসে তার পা দুইটা ঢুকায় দিবে লাকড়ির চুলায়! এখন তারা তিনজন আর টোনা-টুনি! টোনার সাথে টুনির কথাবার্তা বন্ধ, কারণ সে খালি গুড় এনেছে, চালের গুড়া আনে নাই। শাঁকচুন্নি বললো,
– আজকে তোদের ঘাড় মটকাই?
– আজকে না তোমাদের বিয়ে? (সাহেদ)
– কার সাথে বিয়ে আমার? (শাঁকচুন্নি)
– কেন মতিনের সাথে! (সাহেদ)
মতিন ওদিকে মুচকি মুচকি হাসছে, এক হাত দিয়ে মুখ চেপে ধরেছে, আরেক হাত পকেট হাতড়ে বেড়াচ্ছে রুমাল খুঁজতে!
– বিয়ের পর কি আমি মতিনের ঘাড় মটকাতে পারবো? (শাঁকচুন্নি)
– কেন পারবা না, বিয়ের পর স্বামীদের ঘাড় মটকানো মেয়েদের জন্মগত অধিকার! (সাহেদ)

সাহেদ সাহেব অনেকবার মতিনকে খাওয়ার পর তার সাথে থেকে যাওয়ার কথা বলেছেন, সে কোন একটা অদ্ভুত কারণে তার বাসায় থাকে না। সাহেদ সাহেব মনে করার চেষ্টা করলেন মতিনের কথা, মতিন কি কাজ করে এখন? যেদিন আলেয়া (সাহেদ সাহেবের স্ত্রী) মারা গেল সেদিনও ছিল সোমবার, মতিন মিষ্টি হাতে করে সাহেদ সাহেবের বাসায় হাজির! পরে শুনেছিলেন অনার্স-এ ফার্স্ট ক্লাস ফার্স্ট হয়েছে। তাকে অবশ্য কখনও জিজ্ঞাসা করা হয়নি যে সে কি করে! তার প্রায়ই অনেক কিছু জানতে ইচ্ছা হয় না, মানুষের জীবন নিয়ে তার কোন আগ্রহ নেই। কখনও ছিলও না। আচ্ছা ছেলেটা এই অপরাধবোধ থেকে তার সাথে দেখা করতে আসে না তো? মিষ্টি অবশ্য তার খুব একটা পছন্দের না, আলেয়ার অনেক প্রিয় ছিল! আলেয়া আর সে একবার মিষ্টির দোকানে গেল, – কি মিষ্টি দিব? (দোকানি)
– আমি ফুড ইন্সপেক্টর, আপনারা নাকি অস্বাস্থ্যকর পরিবেশে মিষ্টি বানান! (আলেয়া গলাভারী করে বলেছে)
এরপর সাহেদের দিকে আঙুল দেখিয়ে বললো,
– এই এ্যসিস্টেন্ট, চেক কর!
একেবারে তুমি থেকে তুই তাই বলে?? সাহেদ এগোতে লোকটা ঘুষ সাধা শুরু করেছে। সাহেদ দিয়েছে এক কষে চড়, একেবারে কানের নীচ বরাবর। সবাই যখন হতভম্ব, আলেয়া দিয়েছে হেসে! সেই হাসি আর থামে না! সাহেদ আলেয়ার হাত ধরে কোনরকমে দৌড়। না হলে হয়তো দেখা যেত, সাহেদকে বেধে রেখে স্ল্যাপ গেমের আয়োজন করা হয়েছে; যেখানে এক শক্তিশালী যুবক এসে তাকে চড় মারবে তারপর সাহেদের টার্ন! এই গেমে সাহেদ নির্ঘাত হারতো, নাটক সিনেমায় যাকে চড় মারা হয় তার দাত পড়ে যায়, আর সাহেদ দুইদিন হাতের ব্যথা নিয়ে ঘুরেছে!

সাহেদ সাহেবের সারা জীবন কেটেছে রুটিন মাফিক, প্রত্যেকেদিন ভোরে ঘুম থেকে উঠে নামায পড়েন, ঘুষ খাওয়ার জন্যে মাফ চেয়েছেন, হুজুরদের শেখানো বিভিন্ন দোয়া পড়তে গিয়েও পড়েন নি, কারণ তিনি এগুলোর কোনটারই মানে জানেন না! এরপর মর্নিং ওয়াক, দশ মিনিট আগে অফিসে যাওয়া শুরু করে সব কাজ, এখন অবশ্য অফিসের পাট চুকেছে! মতিন গত সপ্তাহে যখন এসেছিল, তাকে বলেছে আঙ্কেল, সারা জীবন তো সার্কেলের মধ্যে থেকে গেলেন, সার্কেলের বাইরে এসে একটু ভাবার চেষ্টা করুন!
– কিরকম?
– ধরুন, আপনি একটু অস্বাভাবিক কাজ করা শুরু করলেন। এই যেমন হিমুর মত রাস্তায় খালি পায়ে হাটতে পারেন!
– এটা অস্বাভাবিক কিছু না রে ব্যটা, তোমার ধারণা আছে বাংলাদেশের কত শতাংশ মানুষ খালি পায়ে হাঁটে? এরাউন্ড পচিশ শতাংশ!
– ও, আচ্ছা। তাহলে অন্য কিছু করুন, যেটা করে আপনার ভালো লাগবে। একটা ভার্চুয়াল গার্লফ্রেন্ড বানান। একটা নাটকে দেখেছিলাম, এক বয়স্কা মহিলা একা একা থাকেন সে একটা আঠারো-উনিশ বছরের মেয়ের ছবি দিয়ে সোসাল মিডিয়তে একটা আইডি খুলে কোন এক ছেলের সাথে চ্যটিং করেন! কাইন্ড অফ সুগার ড্যাডি টাইপ হবেন আর কি! তবে ভুলেও সুগার বেবির সাথে দেখা করতে যাবেন না!

সাহেদ সাহেব সুগার ড্যাডির মানে বোঝেন নি, জিআরই তে এরকম কোন ওয়ার্ড ছিল না! তার ধারণা জিআরই একটা হুদাই পড়া! তবে তিনি এর মানে আন্দাজ করতে পারছেন।
– ধুর, নাটকেই এসব সম্ভব।
– আচ্ছা ক্রিয়েটিভ কিছু করেন। এই মনে করেন ইউটিউবে ভিডিও দেখে কাগজ দিয়ে কিছু একটা তৈরী করে ফেললেন, অথবা কবিতা লেখা শুরু করেন। অনেক বাংলা গান রয়েছে যেটার পরবর্তি ইতিহাস মানুষ জানতে চায়, সেগুলোর সিক্যুয়াল লিখে ফেলতে পারেন, যেমন রঞ্জনা আমি আর আসবো না বা বেলাবোস কিংবা রুকজানা! আমি অবশ্য বেলাবোসের সিক্যুয়াল লিখে ফেলেছি, শুনবেন?
– শোনাও দেখি!
“স্বপ্নটা আজ ভেঙে গেছে বেলা শুনছ
অনেক দূরের পথে তোমার বাস
আমার হাতে হাতকড়ি আর
পকেট ভর্তি ক্ষুধা
সবটুকুই কি কারো অভিশাপ!

তোমার বাবার আর্জি ছিল অনেক
এগারোশ’তে চলবে কত দিন?
বেতনটাও থমকে গেল
মিথ্যে কথার ভীড়ে
স্বপ্নের কারখানা, রঙহীন!

এটা কি টু ফোর ফোর, ওয়ান ওয়ান থ্রি-নাইন
জানেন কি কেউ বেলার সংবাদ!
ভালবাসা আজ মিইয়ে গেছে সকালের পানি-ভাতে
বেলাকে আজ খুবই দরকার!”

– বাহ, বেশ বেশ! আমার পক্ষে ছন্দ মেলানো টাফ!
-আচ্ছা গল্প লিখেন তাহলে, একটা কিছু তো এটলিস্ট করেন।
-গল্প লেখা যায়, কিন্তু কিভাবে শুরু করবো?
-প্রথমে মনের কথা গুলো মনে মনে গুছান, যা মাথায় আসে! তারপর কাগজে লিখেন বা টাইপও করতে পারেন; যেমনটা সুবিধা।

২.
আলেয়া সাহেদ সাহেবকে ডাকছেন, তার গোসলের সময় হয়েছে। দুপুর বেলায় রোদে বসে অনেক ওলট-পালট চিন্তা হয়েছে। মতিন ক্যরেক্টারটা কি গল্পে বেশী কথা বলে? বললে বলুক, কিছুই আসে যায় না! তার এই লেখা কেউ পড়বে না তিনি তা ভালো করেই জানেন। ফ্রিজে ইলিশ আছে কিনা কে জানে! মতিন ইলিশ মাছ খেতে পছন্দ করে হয়তো! তিনি কি মাছ নিয়ে তার জন্যে অপেক্ষা করবেন, যদি ছেলেটা আসে কোন কারণে? তিনি এসব কি ভাবছেন, মতিন বলে কেউ নেই! সাহেদ সাহেব ঘরে ঢুকলেন, দুই কামরার বাড়ি তিনি কোন কারণ ছাড়াই ভাড়া নিয়েছেন।
-আলেয়া পানি গরম করো, গোসল করবো।
সাহেদ সাহেব নিজেই চুলা জ্বালালেন।

৩.
দরজায় কে জানি নক করতেছে! বাইরে থেকে কড়া সিগারেটের গন্ধ আসছে, ঠিক সিগারেট না এটা পাতার বিড়ির গন্ধ! পাতার বিড়ি একমাত্র মতিনই খায়!

সাহেদ সাহেব বাজারের ব্যাগ হাতে নিলেন, দরজা খুলে দেখলেন কেউ নেই! আলেয়া শোয়ার ঘর থেকে বলে উঠলো, এই তাড়াতাড়ি ফিরো!! সাহেদ সাহেব শোয়ার ঘরের দিকে তাকালেন, সেখানেও কেউ নেই।।

SabbiRif এর সবগুলি গল্প পড়ুন এখানেঃ সাব্বিরিফ

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here

Reviews

Popular Articles