বাংলাদেশে আমরা অনেক খাবার না বুঝে হারাম খেয়ে ফেলি, তবে প্রথমে অস্ট্রেলিয়ার কাহিনী দিয়ে শুরু করি!
বিদেশে এসে সবচেয়ে বেশী যে সমস্যার সম্মুখীন হতে হয়েছে তা হলো হালাল হারাম বেছে খাওয়া। মুরগীর কথা প্রথমে কেন বললাম, তার কারণ হচ্ছে – এক ধরণের মানুষ এখানে আছে যারা ভাবেন, মুরগী একটি হালাল প্রাণী, একে খাওয়াও হালাল। সবসময় জানি হালাল হওয়ার আরও কিছু শর্ত আছে, তারপরও ওটুকু স্যাক্রিফাইস করে খেয়ে ফেলি, ভাবি আল্লাহ মাফ করে দিবেন!
‘…তবে কি তোমরা কিতাবের কিছু অংশে ঈমান রাখো আর কিছু অংশ অস্বীকার করো? সুতরাং তোমাদের মধ্যে যারা তা করে, দুনিয়ার জীবনে লাঞ্ছনা ছাড়া তাদের কী প্রতিদান হতে পারে! আর কিয়ামতের দিন তাদের কঠিন আজাবে নিক্ষেপ করা হবে। তোমরা যা করো, আল্লাহ সে সম্পর্কে গাফিল নন।’ (সুরা : বাকারা, আয়াত : ৮৫)
সুস্পষ্ট ভাবে শর্ত গুলো হলোঃ মুসলমানদের জন্য মৃত পশু হারাম; আল্লাহর নামে ছাড়া অন্য জবাই করা পশুও হারাম; জবাইকারী যদি অমুসলিম হয় তাহলে সেই গোশতও হারাম।
হালাল খাবার সম্পর্কে কুরআনে কি বলা হয়েছে দেখে আসা যাকঃ
এক. হে মুমিনগণ! আল্লাহ তোমাদের জন্য যেসব উৎকৃষ্ট বস্তু হালাল করেছেন তাকে হারাম সাব্যস্ত করো না এবং সীমালঙ্ঘন করো না। নিশ্চয়ই আল্লাহ সীমালঙ্ঘনকারীদের ভালোবাসেন না। আল্লাহ তোমাদের যে রিজিক দিয়েছেন, তা থেকে হালাল, উৎকৃষ্ট বস্তু খাও এবং যেই আল্লাহর প্রতি তোমরা ইমান রাখো তাকে ভয় করে চলো। (সুরা মায়েদা : ৮৭-৮৮ )
দুই. হে মুমিনগণ! মদ, জুয়া, প্রতিমার বেদি ও লটারির তীর এসবই অপবিত্র, শয়তানি কাজ। সুতরাং এসব পরিহার করো, যাতে তোমরা সফলতা অর্জন করো। শয়তান তো মদ-জুয়া দ্বারা তোমাদের মধ্যে শত্রুতা ও বিদ্বেষের বীজ বপন করতে চায় এবং চায় তোমাদের আল্লাহর জিকির ও নামাজ থেকে বিরত রাখতে। সুতরাং বলো, তোমরা কি (ওসব জিনিস থেকে) নিবৃত্ত হবে? (সুরা মায়েদা : ৯০-৯১)
তিন. সুতরাং এমন সব (হালাল) পশু থেকে খাও, যাতে আল্লাহর নাম নেওয়া হয়েছে, যদি তোমরা সত্যিই তার নিদর্শনাবলিতে ইমান রাখো। (সুরা আনআম : ১১৮)
চার. তোমাদের জন্য এমন কী বাধা আছে, যা দ্বারা তোমরা যেসব পশুতে আল্লাহর নাম নেওয়া হয়েছে তা থেকে খাও না? অথচ তিনি তোমাদের জন্য (সাধারণ অবস্থায়) যা কিছু হারাম করেছেন তা তিনি তোমাদের বিশদভাবে জানিয়ে দিয়েছেন, তবে তোমরা যা খেতে বাধ্য হয়ে যাও (তার কথা ভিন্ন, হারাম হওয়া সত্ত্বেও তখন তা খাওয়ার অনুমতি থাকে)। বহু লোক কোনো রকমের জ্ঞান ছাড়া (কেবল) নিজেদের খেয়ালখুশির ভিত্তিতে অন্যদের বিপথগামী করে। নিশ্চয়ই তোমার প্রতিপালক সীমালঙ্ঘনকারীদের সম্পর্কে সবিশেষ অবহিত। (সুরা আনআম : ১১৯)
পাঁচ. যে পশুতে আল্লাহর নাম নেওয়া হয়নি, তা থেকে খেয়ো না। এরূপ করা কঠিন গুনাহ। (হে মুসলিমগণ!) শয়তান তার বন্ধুদের তোমাদের সঙ্গে বিতর্ক করার জন্য প্ররোচনা দিতে থাকে। তোমরা যদি তাদের কথামতো চলো, তবে তোমরা অবশ্যই মুশরিক হয়ে যাবে। (সুরা আনআম : ১২১)
ছয়. (হে নবী! তাদের) বলো, আমার প্রতি যে অহি নাজিল করা হয়েছে, তাতে আমি এমন কোনো জিনিস পাই না, যা কোনো আহারকারীর জন্য হারাম, যদি না তা মৃত জন্তু বা বহমান রক্ত কিংবা শূকরের গোশত হয়। কেননা তা নাপাক। অথবা যদি হয় এমন গুনাহের পশু, যাকে আল্লাহ ছাড়া অন্য কারও নামে জবাই করা হয়েছে। হ্যাঁ যে ব্যক্তি বাধ্য হয়ে যায়, আর তার উদ্দেশ্য মজা নেওয়া নয় এবং প্রয়োজনের সীমালঙ্ঘন করে না, তবে নিশ্চয়ই আল্লাহ অতি ক্ষমাশীল, পরম দয়ালু। (সুরা আনআম : ১৪৫)
অস্ট্রেলিয়াতে আরেকটা ব্যপার হচ্ছে, অনেকে বলেন যেসব মুরগী হালাল সার্টিফাইড বিক্রি করা হয়, সেগুলো আসলে হালাল না, এগুলো মেশিনে কাটা হয়!
রসুলুল্লাহ (সা.) বলেন, ‘প্রবঞ্চক বেহেস্তে যেতে পারবে না’—তিরমিযি।
প্রবঞ্চনার দ্বায়ভার কার এ নিয়ে আরো বিস্তারিত আলোচনা করা যেতে পারে।
বাংলাদেশে তো আমরা প্যাকেটজাত বিদেশী বিস্কিট, চকলেট, জুস, আইসক্রিম পাইলেই হালাল-হারাম না চিন্তা করে খেয়ে ফেলি! আমাদের মাথাতেও আসে না, জুস/আইসক্রিম কিভাবে হারাম হয়, তাই না? অস্ট্রেলিয়াতে এসে আমি চোখ বন্ধ করে একসময় এগুলা খাইছি, কারণ আমারও একই ধারণা ছিল! এখন একটু বেছে খাওয়ার চেষ্টা করি। আপনি যদি মুসলমান হন, তাহলে এটা কিন্তু আপনার দায়িত্বের মধ্যে পড়ে আরেকজন মুসলমানকে হালাল খাবার দেওয়া!
হাদিস শরিফে এসেছে,
আয়েশা সিদ্দিকা রাযি. বলেন, একদল লোক নবী রাসুলুল্লাহ ﷺ-কে জিজ্ঞেসা করল, ‘এক মুসলিম সম্প্রদায় আমাদের নিকট গোশত নিয়ে আসে। আমরা জানি না যে, তার জবেহকালে আল্লাহর নাম উচ্চারণ করা হয়েছে কি না।’ তিনি বললেন, سَمُّوا عَلَيهِ أَنتُم وَكُلُوهُ ‘তোমরা আল্লাহর নাম নিয়ে তা ভক্ষণ কর।’ (বুখারি ২০৫৭, ৫৫০৭ )
উক্ত হাদিসের ব্যাখ্যায় হাফেজ ইবন হাজার আসকালানী রহ. বলেন,
‘মুসলমানদের বাজারে যে গোশত পাওয়া যায় তা হালাল হিসেবে গণ্য হবে। কেননা, মুসলমানের সব বিষয়ে ততক্ষণ পর্যন্ত ভালো ধারণা রাখতে হয় যতক্ষণ পর্যন্ত এর বিপরীত স্পষ্ট প্রমাণ পাওয়া যায়।’ (ফাতহুল বারী ৯/৭৮৬)
যদি আপনি হালাল-হারাম নিয়ে সত্যিই কনসার্ন হন, তাহলে আর এখন হুট করে খাবেন না। জাস্ট ২ সেকেন্ড লাগবে চেক করতে প্যাকেটজাত যে প্রোডাক্টটা কনসিউম করছেন, সেটা হালাল কি না!
আল্লাহ তোমাদের হালাল ও পবিত্র যে রিজিক (জীবনোপকরণ) দান করেছেন, তা থেকে তোমরা আহার করো এবং আল্লাহর অনুগ্রহের কৃতজ্ঞতা আদায় করো, যদি তোমরা শুধু তাঁরই ইবাদত করো। [সুরা : নাহল, আয়াত : ১১৪ (প্রথম পর্ব)]
কিভাবে চেক করব প্যাকেটজাত দ্রব্য হালাল কি না?
১. প্রোডাক্টের গায়ে যদি হালাল সাইন থাকে তাহলে তো হলোই।
২. যদি ভেজিটেরিয়ান সাইন থাকে, বা লেখা থাকে সুইটেবল ফর ভেজিটেরিয়ান, তাহলে সমস্যা একটু কম। এক্ষেত্রে দেখা জরুরি যে কোন এলকোহল জাতীয় দ্রব্য খাবারে আছে কি না!
৩. প্লে স্টোর বা অ্যাপ স্টোর থেকে “Halal Check E-number & E-codes” অ্যাপটা ডাউনলোড করে নিই।
নীচের ছবিতে Ingredients এর একটা লিস্ট আছে। যদি আমরা সেই লিস্টটা ধরে ধরে এই অ্যাপ এ ইনপুট দিই, তাহলে খুব সহজে বের করতে পারবো, প্রোডাক্টটা হালাল কি না! সব কিছুতো আর চেক করার দরকার নেই, কারন এর মধ্যে কিছু আমরা এমনিতেই জানি এগুলো হালাল! যেমনঃ Wheat Flour, Vegetable oil, Sugar.
যেগুলো জানিনা সেগুলো চেক করলেই হবে। যেমন – Emulsifier (472e)
২য় ছবিতে দেখা যাচ্ছে, (472e) আসলে Mushbooh, তার মানে এটা হালালও হতে পারে আবার নাও হতে পারে। সাধারণত এটা ভেজিটেবল থেকেই তৈরী হয়, তবে এনিমেল ফ্যাট (যেমন পর্ক) থাকতে পারে।
এরকম সন্দেহ থাকলে এটাই উত্তম যে খাবারটা পরিহার করা, আনলেস আপনার বেঁচে থাকার জন্যে এটাই একমাত্র খাবার না হয়ে থাকে।
তবে, প্রোডাক্টের গায়ে আবার Emulsifier (472e, soy) লেখা থাকলে সেটা কিন্তু আবার খাওয়া যাবে। কারণ এটা ইন্ডিকেট করে যে, 472e আসলে soy থেকে তৈরী।
অস্ট্রেলিয়াতে যারা থাকেন, তারা অনেক সময়ই বলেন, Coles এ যে গরুর মাংস সাপ্লাই হয়, তা হালাল, কেউ বলেন হালাল না! খুব সুন্দর একটা ওয়েবসাইট আছে, চেক করারঃ
আপনি জাস্ট ওয়েবসাইটে গিয়ে EST নাম্বারটা ইনপুট করুন, ওয়েবসাইটই বলে দিবে হালাল না হারাম!
আল্লাহ আমাদের হেদায়েত দান করুন, আমরা যদি এতদিন যেকোন কারণে হারাম খাবার গ্রহন করে থাকি রমজান মাসের ওসিলায় আমাদের মাফ করে দিন এবং সামনে যেন আমরা সবসময় হালাল খাবার খেতে পারি তার তৌফিক দান করুন। আমিন।