হারিয়ে গিয়েছে সাদাকালো দিনের সেই ‘টেম্পুগাড়ি’
চার চাকার গাড়িকে টেম্পু বলা হলেও আমাদের দেশে এবং বিশেষ করে বিভিন্ন অঞ্চল ভেদে তিন চাকায় ইঞ্জিনে চালিত গাড়িকেই টেম্পু বা বেবি ট্যাক্সি নামে ডাকা হয়। মূলত পেট্রোল বা ডিজেল ইঞ্জিনে চালিত গাড়ি এটি। কয়েক দশক আগে এই গাড়ি সগৌরবে যাত্রী এবং মালামাল পরিবহন করে থাকলেও আজকের দিনে টেম্পু গাড়ির এই বিশেষ শ্রেণীকে আর খুব একটা চলতে দেখা যায় না বললেই চলে। সারা বাংলাদেশ খুঁজলে প্রত্যন্ত গ্রামে হয়তো এখনো দুই একটি এই গাড়ির দেখা পাওয়া যেতে পারে। তবে, সেই সম্ভাবনা অতীব ক্ষীণ। আজকের দিনের অনেক মানুষ হয়তো টেম্পু গাড়ির এই বিশেষ শ্রেণীকে কখনো চোখেই দেখেননি। সময়ের সাথে সাথে তুলনামূলক কম ক্ষমতা সম্পন্ন এই গাড়িটি মানুষের জীবনরেখা থেকে অদৃশ্য হয়ে গিয়েছে। কিন্তু তারপরেও যে মানুষগুলো এই গাড়ির কথা জানেন, যারা এই গাড়িতে ভ্রমণ করেছেন তারা এই গাড়ির সোনালী অতীত অবশ্যই স্মরণ করবেন।
‘টেম্পু’ শব্দটা :
ইংরেজি শব্দ ‘TEMPO’ এর বাংলা অর্থ করলে দাড়ায় যে ‘সংগীতের তাল বা লয়’। এই গাড়িটি খুব শব্দ করে চলতো বলে একে ‘টেম্পু’ নামেই বাজারে পরিচয় করানো হয়। তবে কে বা কারা এই নামকরণ করেছেন এর কোন ইতিহাস খুঁজে পাওয়া যায় না। সংগীত এবং যানবাহনকে এভাবে সম্পর্কিত করার একমাত্র কারণ হচ্ছে শব্দ৷
টেম্পু নামের দ্বন্দ্ব :
‘টেম্পু’ এই নামটুকু নিয়ে অনেকের অনেক রকম মত রয়েছে। আর সেটা থাকাটা খুব একটা অস্বাভাবিক নয় কারণ বাংলাদেশের বিভিন্ন অঞ্চল ভেদে বিভিন্ন তিন চাকার যান্ত্রিক যানবাহনকে এই একটি (টেম্পু) নামেই ডাকা হয়ে থাকে। তবে প্রকৃতপক্ষে CNG, লেগুনা, ইজিবাইক, টোটো, বেবিট্যাক্সি, নসিমন, গ্রামবাংলা, ইঞ্জিন ভ্যান, মহেন্দ্র এই সবগুলো গাড়ির সাধারণ নাম হচ্ছে টেম্পু গাড়ি। অঞ্চল ভেদে এবং কিছু ক্ষেত্রে শক্তির উৎস ভেদে টেম্পু গাড়ির নামই পরিবর্তিত হয়ে আজকের এই গাড়িগুলোর নাম হয়েছে। এখন একথা নিঃসন্দেহে বলা যায় যে ‘টেম্পু গাড়ি’ই আজকের সকল তিন চাকা যন্ত্রচালিত গাড়ির আদিম সংস্করণ।
কেমন ছিলো প্রথম দিকের টেম্পু গাড়ি?
প্রায় ১৫০ কেজি ওজনের তিন চাকা ওয়ালা এই গাড়িটির পিছনে বসার জন্য চারটি সিট এবং সামনে ড্রাইভার সহ একটি সিট নিয়ে এই গাড়ি রাস্তায় নামে। প্রতি ঘন্টায় এর গতিবেগ মাত্র ৩০ বা ৩৫ কিলোমিটার এবং সর্বোচ্চ ২৫ কিলোমিটার মাইলেজ। এই গাড়ির সবথেকে মজার বিষয় ছিলো এই গাড়িকে স্টার্ট করা। একটি লম্বা লোহার রড ছিল এই গাড়িকে স্টার্ট করার উপায়। হ্যাঁ শুনতে তো একটু অবাক লাগবে অবশ্যই। ওই লম্বা লোহার রড টি ইঞ্জিনের সাথে জোড়া থাকতো এবং হ্যাচকা টানের মাধ্যমে গাড়ির ইঞ্জিন স্টার্ট করা হতো। অনেকটা আজকের দিনে মোটরসাইকেল এনালগ সিস্টেমে স্টার্ট করার মতো৷ আজকের দিনের সিএনজির সাথে এই টেম্পু গাড়ির মিল লক্ষ্য করা যায়। টেম্পু গাড়িতেই মূল শক্তির উৎস পরিবর্তন করে আজকের দিনের সিএনজিতে পরিবর্তিত করা হয়েছে। আসলে টেম্পু এবং সিএনজির মধ্যে ইঞ্জিন উৎসের পার্থক্য ছাড়া আর পরিবর্তন লক্ষ্য করা যায় না।
‘টেম্পু’ গাড়ির ছোট্ট ইতিহাস:
ধারণা করা হয় যে, ৬০ বা ৭০ এর দশকে এই গাড়িকে প্রথম রাস্তায় দেখা যায়। তবে অবশ্যই সেই গাড়ির সংখ্যা টা খুব একটা বেশি ছিল না। হয়তো সারা ঢাকা শহরে ২০/২৫ খানা টেম্পু চলতো। কিন্তু যত দিন আগাতে শুরু করলো এই গাড়ির উপস্থিতি রাস্তায় আরও বেড়ে গেল। আজকের দিনের মতোই স্বল্প দূরত্বে খুব স্বল্প সময়ে পৌঁছানোর জন্য এই গাড়িটি জনপ্রিয় হয়ে উঠলো। অন্তত লোকাল পাবলিক বাস এবং রিক্সার থেকে দ্রুত পৌঁছাতো এই টেম্পু। যাত্রী পরিবহনের পাশাপাশি শহরের বিভিন্ন জায়গায় মালামাল সরবরাহের জন্য এই গাড়িটি অত্যন্ত জনপ্রিয় হয়ে উঠলো। ৯০ এর দশক আসার পরে দেখা গেল সারা বাংলাদেশে এই গাড়িটি তুমুল জনপ্রিয়তা লাভ করেছে। বিভিন্ন অফিসের কাজ থেকে শুরু করে পোস্ট অফিস, সরকারি অফিসে মালামাল পরিবহন, দোকানের জিনিসপত্র বিতরণ ইত্যাদি সকল কাজ স্বগৌরবে করে আসছিলো এই টেম্পু গাড়ি। এই গাড়ির অন্যতম সুবিধা ছিল তিন চাকা বিশিষ্ট হওয়ার কারণে খুব অল্প জায়গা দিয়ে চলাফেরা করতে পারতো। এরপর আরো সময় গড়ায়। সময়ের সাথে সাথে দেখা গেলো বাংলাদেশের প্রত্যন্ত অঞ্চলেও পৌঁছে গেছে এই টেম্পু গাড়ি।
বর্তমানের রূপান্তরিত টেম্পু গাড়ি:
২০০০ সালের পর থেকে আস্তে আস্তে টেম্পু গাড়িকে পরিবর্তন করা শুরু হয়। তুলনামূলক শক্তিশালী ইঞ্জিন, গ্যাস ইঞ্জিন ব্যবহার করে টেম্পু গাড়িকে আরো বেশি গতিশীল এবং ধারণক্ষমতা সম্পন্ন করা হয়। আস্তে আস্তে আমাদের মধ্যে জনপ্রিয়তা লাভ করে CNG, মনেন্দ্র, টোটো ইত্যাদি নাম৷ ২০১০ সালের পর থেকে সারাদেশে এই পরিবর্তন ছড়িয়ে পড়ে এবং আগের টেম্পু আরো বেশি শক্তিশালী হয়ে আমাদের মধ্যে ফিরে আসে। কিন্তু আমরা সময়ের প্রবাহে হারিয়ে ফেলেছি ‘টেম্পু’ নামটি। অনেকে আবার এই নাম শোনেননি এমনও পাওয়া যেতে পারে৷
ইদানীং সময়ে জন্মানো ছেলেমেয়েরা টেম্পু গাড়ি বললে কখনোই চিনতে পারবে না। প্রযুক্তির ছোঁয়ায় পুরাতন টেম্পু গাড়ি নতুন ভাবে আমাদের মধ্যে ফিরে আসলেও আগের ‘টেম্পু’ নামটি আমরা হারিয়ে ফেলেছি। অনেক জায়গাতেই পরিত্যক্ত টেম্পু গাড়ি দেখা যায়। হয়তো এখান থেকে আরও দশ বছর পরে এগুলোও আর দেখা যাবে না। আমরা চিরতরে হারিয়ে ফেলবো আমাদের ৭০ এর দশকের জনপ্রিয় এক যান্ত্রিক যানবাহনকে। ধুলো জমবে আমাদের বাঙালীর যান্ত্রিক সভ্যতার একটি স্তরের ওপর। হারিয়ে যাবে আজকের তিন চক্র যানবাহনের প্রথম সৃষ্টি।
Onke sundor hoycha. .