মহাভারত নিয়ে এ পর্যন্ত জল কম ঘোলা হয়নাই! নানা মুনির নানা মতের মতন কালের আখ্যানে মহাভারত নামক মহাকাব্যের অনেক রুপ দেখে যাচ্ছে পৃথিবীবাসী।
ব্যক্তিগত ভাবে মনে করি যে সব মহাকবি এই মহাকাব্যের বিভিন্ন স্রোতে নিজেরদের মত করে বর্ননা করেছেন তার মধ্যে কৃষ্ণ দ্বৈপায়ন বেদ ব্যাস রচিত মহাভারতই দৈব তুল্য। এ নিয়ে বিস্তর লেখালেখি হয়েছে, ভবিষ্যতেও হবে তবে “জল ঘোলা” করা মাছ শিকারি লেখকদের মাঝে দুই একজন যে একেবারে মাষ্টার মাইন্ড’ লেখা লিখে ফেলবেন এ বোধগম্য এবং এঁরাই হয়ে থাকবেন পরম পূজনীয় ।
আজ এমন একজন নাম না জানা দেবতুল্য লেখকের বই পড়লাম! পরিচয়ের ফ্ল্যাপেই লেখা- “ হয়তো লেখকের আর কয়েকটি লেখা বেরোবে, হয়তো আর বের হবেনা, কে জানে? আলস্য প্রিয় এই লেখক তাতে মোটের ওপর তৃপ্ত; প্রবেশ ও প্রস্থানের মধ্যে এই সংক্ষিপ্ত যাত্রাপথে যা লিখেছেন যা মুছেছেন, শূন্যের মাঝে মিলিয়ে যাক, তিনি দাম ধরা-ধরিতে নেই”
এতক্ষণ যার কথা লিখলাম তিনি সৌরভ মুখোপাধ্যায়, জীবন যার কেটে গেল হাওড়ার গ্রামে, ইংরেজির মাষ্টারি করে! অথচ তার হাত ধরেই রচিত হয়েছে মহাভারতের এক অসামান্য অতীত ,যাকে আমরা ইংরেজিতে বলি- প্রিকুয়্যেল।
বইটির নাম ‘প্রথম প্রবাহ’, লেখা মহাভারতের ভূতপূর্ব অলংকরণ নিয়ে যেখানে কথক ব্যাসদেব এবং অনুলেখক গনপতির ভূমিকা ব্রেশটিয় নাটকের স্মৃতি উস্কে দেয়। বাংলাভাষাভাষীদের নিকটে এ এক অভিনব আয়োজন মহাকাব্য নিয়ে।
কাহিনির পরতে পরতে আছে নানা ধরনের টুইষ্ট। প্রতিটি চ্যাপ্টারে কৌতূহলদ্দিপকের রেশ। বইটি পড়ে শুধু মহাভারত সম্পর্ক নয় বরং মানব সমাজের কূটীল ও জটিল বিষয় নিয়ে পাঠককে ভাবাতে বাধ্য করবে বলে আমার বিশ্বাস। অনেকেই বলেন যে মহাভারতের অন্যতম নায়ক হলেন কৃষ্ণ অথবা কিন্ত আমার কাছে মহাভারতের অন্যতম নায়ক ভীষ্ম ও তার প্রতিজ্ঞা। ধর্মপুত্র যুধিষ্ঠিরও হার মেনে যাবে তার প্রতিদান ও প্রতিজ্ঞার কাছে। ভীষ্মের আসল নাম কিন্ত গঙ্গানন্দন, মা গঙ্গার অষ্টম পুত্র এই যুবরাজ দেবব্রত। মহাভারতে অসীম সাহসী যদি আর কেউ ছিলেন তবে এই প্রতিজ্ঞাবদ্ধ যুবরাজ, যিনি নিজের পিতার জন্যে জাগতিক সকল ইচ্ছা এবং অধিকার হারিয়ে প্রতিজ্ঞাবদ্ধ হয়ে সারাজীবন অকৃতদার এবং সাম্রাজ্যের উত্তরাধিকার ত্যাগ করেন। বরং নিজেকে সঁপে দেন জাগতিক সকল সুখ দুঃখের উর্ধ্বে। সারা মহাকাব্য জড়েই নিজেকে রাজার ‘ হান্ড অফ কিং” হিসেবে মেনে নিয়ে সেবা করে গেছেন।
আর একজন হলেন সত্যবতী, সকল কুটীলতার শুরু তার চরিত্রের থেকেই। যদিও অনেকের কাছে এ এক অসামান্য প্রেম কাহিনি মনে হতে পারে। প্রেম ও কামনা যে মানবিক মর্যাদা কোথায় নিয়ে যেতে পারে সেটা এ বই পড়া শুরু করলেই পাঠক মাত্রই বুঝতে পারবে। সত্যবতী সম্পর্কে তেমন বলছি না আর ( কারন নারীর মন কে কবে বুঝেছে যে লিখে ধারণা দিতে পারবে?)
এই উপন্যাসের কোন তুলনা হয়না। তবে এক্টিবার শুধু নরডিক হিষ্ট্রি নিয়ে জর্জ আর আর মার্টিনের গেম অফ থ্রনসের কথা মনে হচ্ছিল! তিনি যেমন এর প্রিকুয়্যেল নিয়ে টারগারিয়ান ইতিহাস ‘ফায়ার এন্ড ব্লাড লিখেছেন তেমনি সৌরভ মুখোপাধ্যায়ও মহাভারতের হিষ্ট্রি নিয়ে এই এক চমৎকার উপন্যাস লিখেছেন।
অনেক কিছুই লেখা যেত কাহিনি নিয়ে কিন্ত তাতে প্রকৃত রস আস্বাদনে বিরতি পরবে। সুতরাং এখানেই আমার সমাপ্তি। পাঠক, টান টান উত্তেজনাপূর্ণ মহাকাব্যে আপনাদের স্বাগতম!