কিলারদের মনস্তত্ত্ব: অন্ধকার মানসিকতার রহস্য উন্মোচন

আলিফ খান, আইন বিভাগ, ইস্ট ওয়েস্ট ইউনিভার্সিটি

0
9

সিরিয়াল কিলাররা দীর্ঘদিন ধরে সমাজকে ভয় ও বিস্ময়ে আচ্ছন্ন করে রেখেছে। তাদের ভয়াবহ অপরাধ ও মনস্তাত্ত্বিক জটিলতা তাদেরকে গবেষণার গুরুত্বপূর্ণ বিষয় করে তুলেছে। কী তাদের হত্যা করতে উদ্বুদ্ধ করে? তারা কি জন্মগতভাবে অপরাধপ্রবণ, নাকি পারিপার্শ্বিক কারণ তাদের এই পথে ঠেলে দেয়?

সিরিয়াল কিলার কাকে বলে?

সিরিয়াল কিলার হলেন সেই ব্যক্তি, যিনি তিন বা তার বেশি হত্যাকাণ্ড সংঘটিত করেন এবং প্রতিটি হত্যার মধ্যে একটি নির্দিষ্ট বিরতি থাকে। গণহত্যাকারীদের মতো একবারে অনেক লোককে হত্যা না করে, তারা দীর্ঘ সময় ধরে নির্দিষ্ট কিছু প্যাটার্ন অনুসরণ করে তাদের শিকার বেছে নেন।

সিরিয়াল কিলারদের অন্য অপরাধীদের থেকে কীভাবে আলাদা করা যায়?

• একাধিক হত্যা: তারা একাধিকবার হত্যা করেন, যা দীর্ঘ সময়ের মধ্যে ঘটে।
• কুলিং-অফ পিরিয়ড: অন্যান্য খুনিদের মতো ধারাবাহিকভাবে হত্যা না করে তারা মাঝে বিরতি নেন।
• মনস্তাত্ত্বিক কারণ: অনেকেই নিয়ন্ত্রণ বা প্রতিশোধের মতো গভীর মনস্তাত্ত্বিক কারণ থেকে হত্যা করেন।
• প্যাটার্ন: নির্দিষ্ট কিছু নিয়ম অনুসরণ করেন এবং একই ধরনের ভুক্তভোগী বেছে নেন।
• পরিকল্পনা: অনেকেই অপরাধ ধরা পড়ার ঝুঁকি এড়াতে পরিকল্পিতভাবে হত্যা করেন।
• অনুতাপের অভাব: অনেক সিরিয়াল কিলার তাদের অপরাধের জন্য অনুশোচনা দেখান না।

সিরিয়াল কিলারের মানসিকতা বিশ্লেষণ

ক্রিমিনোলজিস্ট ও মনোবিজ্ঞানীরা বিভিন্ন তত্ত্বের মাধ্যমে সিরিয়াল কিলারদের আচরণ ব্যাখ্যা করেছেন।

১. মনোবিশ্লেষণ তত্ত্ব (Psychoanalytic Theory)

সিগমুন্ড ফ্রয়েডের মতে, শৈশবকালের মানসিক আঘাত ও দমন করা আকাঙ্ক্ষা পরবর্তীকালে হিংসাত্মক আচরণে পরিণত হতে পারে।

২. সামাজিক শিক্ষা তত্ত্ব (Social Learning Theory)

মানুষ তার চারপাশের পরিবেশ থেকে আচরণ শেখে। যারা সহিংস পরিবেশে বড় হয়, তারা সহিংসতাকে স্বাভাবিক হিসেবে গ্রহণ করতে পারে।
উদাহরণ: টেড বান্ডি, যার শৈশবকালীন অশান্ত পরিবেশ তার সহিংস প্রবণতাকে উৎসাহিত করেছিল।

৩. জৈবিক ও জেনেটিক তত্ত্ব (Biological and Genetic Theories)

মস্তিষ্কের অসংগতি, হরমোনের ভারসাম্যহীনতা বা জিনগত কারণ সহিংস প্রবণতা তৈরি করতে পারে।
উদাহরণ: রিচার্ড রামিরেজ, “নাইট স্টকার” নামে পরিচিত, যিনি শৈশবে মস্তিষ্কের আঘাত পেয়েছিলেন যা সহিংসতার সাথে যুক্ত ছিল।

৪. রুটিন অ্যাক্টিভিটি তত্ত্ব (Routine Activity Theory)

যখন অপরাধী তার শিকারকে অনিরাপদ পরিবেশে পায়, তখন অপরাধ সংঘটিত হওয়ার সম্ভাবনা বৃদ্ধি পায়।
উদাহরণ: জেফরি ডাহমার বিচ্ছিন্ন ও নিরাপত্তাহীন স্থানে শিকার খুঁজে নিতেন।

৫. চাপ তত্ত্ব (Strain Theory)

যখন কোনো ব্যক্তি প্রবল সামাজিক বা মানসিক চাপে পড়েন, তখন তারা অপরাধমূলক পথে হাঁটতে পারেন।
উদাহরণ: জন ওয়েন গেসি, যিনি নিজের দ্বৈত পরিচয় নিয়ে সংগ্রাম করছিলেন, যা শেষ পর্যন্ত তাকে হত্যাকারীতে পরিণত করে।

৬. নারীবাদী অপরাধতত্ত্ব (Feminist Criminology)

পুরুষ সিরিয়াল কিলাররা সাধারণত ক্ষমতা বা নিয়ন্ত্রণের জন্য হত্যা করেন, কিন্তু নারী সিরিয়াল কিলাররা আর্থিক লাভ বা প্রতিশোধের জন্য হত্যার প্রবণতা দেখান।
উদাহরণ: আইলিন উওর্নোস, যিনি দাবি করেন যে তিনি আত্মরক্ষার জন্য পুরুষদের হত্যা করেছিলেন।

বাংলাদেশের সিরিয়াল কিলারদের কেস স্টাডি
বাংলাদেশে সিরিয়াল কিলিং তুলনামূলকভাবে বিরল হলেও, কয়েকটি ঘটনা জনসাধারণকে হতবাক করেছে।

এরশাদ শিকদার (১৯৫৫–২০০৪): একসময় শ্রমিক হিসেবে কাজ করা এরশাদ পরে অপরাধ জগতে প্রবেশ করেন এবং একটি কুখ্যাত সন্ত্রাসী গ্যাং গড়ে তোলেন। বহু হত্যার দায়ে তিনি ২০০৪ সালে মৃত্যুদণ্ডে দণ্ডিত হন।

রশু খা: ২০০৭ থেকে ২০০৯ সালের মধ্যে তিনি ১১ জন নারী গার্মেন্টস কর্মীকে হত্যা করেন। তার অপরাধ মূলত ব্যক্তিগত প্রতিশোধ থেকে উদ্ভূত। ২০০৯ সালে গ্রেফতারের পর ২০১৫ সালে তাকে মৃত্যুদণ্ড দেওয়া হয়।

এই ঘটনাগুলো বাংলাদেশের আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর জন্য বড় চ্যালেঞ্জ হয়ে দাঁড়িয়েছিল।

পুরনো ও আধুনিক তত্ত্বের তুলনা
প্রথমদিকে সিরিয়াল কিলিং নিয়ে বেশ কিছু অবৈজ্ঞানিক ও কুসংস্কারভিত্তিক মতবাদ প্রচলিত ছিল:
• অ্যাটাভিস্টিক তত্ত্ব (১৮৭৬): চেজারে লোমব্রোসো বিশ্বাস করতেন যে কিছু মানুষ জন্মগতভাবেই অপরাধী।
• দৈত্যতত্ত্ব: মনে করা হতো যে হত্যাকারীরা শয়তানের অধিকারভুক্ত।
• ফ্রয়েডিয়ান মনোবিশ্লেষণ: দমন করা শৈশবকালীন অনুভূতিকে অপরাধের কারণ হিসেবে ধরা হতো।
• সামাজিক ডারউইনিজম: মনে করা হতো যে সিরিয়াল কিলিং একটি প্রাকৃতিক নির্বাচনের অংশ।

অপরদিকে, আধুনিক গবেষণা মনস্তাত্ত্বিক, সামাজিক ও জৈবিক বিশ্লেষণের মাধ্যমে সিরিয়াল কিলিংকে আরও বৈজ্ঞানিক দৃষ্টিকোণ থেকে ব্যাখ্যা করছে।

সিরিয়াল কিলারদের প্রতিরোধ করা সম্ভব?

সিরিয়াল কিলাররা সমাজের এক রহস্যময় ও ভয়াবহ বাস্তবতা। যদিও তাদের আচরণের একটি নির্দিষ্ট কারণ নির্ধারণ করা কঠিন, আধুনিক গবেষণা কিছু মূল্যবান অন্তর্দৃষ্টি প্রদান করে।
এদের মনস্তত্ত্ব ও কার্যকলাপ বোঝার মাধ্যমে আইনশৃঙ্খলা বাহিনী অপরাধীদের দ্রুত চিহ্নিত ও প্রতিরোধ করতে পারে।
সিরিয়াল কিলারদের বোঝা শুধু একাডেমিক গবেষণার বিষয় নয়—এটি সমাজকে আরও নিরাপদ করার একটি গুরুত্বপূর্ণ পদক্ষেপ।

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here