নব্বই দশকের শুরুর ঈদের কথা আমার এখনো মনে পড়ে! আহ সে কি সোনালি দিন ছিল ভাবতেই রোমাঞ্চিত হয় মন। ঈদ মানে নতুন পোশাক, মজার খাবার, ঈদ মানে উৎসবের মিলনমেলা। বছরে দুটো ঈদের জন্য অধীর আগ্রহে অপেক্ষা করত বাচ্চারা। ঈদ উপলক্ষে বিভিন্ন স্থানে মেলা বসত। বর্তমান সময়ে ঈদের সেই মজা আর নেই, আসলে সময় পাল্টে গেছে হয়তো আমরাও বড় হয়ে গিয়েছি এটাও কারন। তবে আমি মনে করি সবারই শৈশবের ঈদ নিয়ে অনেক বেশি আবেগ কাজ করে। তা যাই হোক আমি ৩৫ বছরের জীবনে বিভিন্ন সময়ের ইদের তুলনামূলক স্মৃতিচারণ করতে চেস্টা করব।
যখন আমি দশ বছরের ছোট তখন ঈদ মনে হয় বেশি আনন্দ নিয়ে আসত। ঈদে নতুন পোশাক কেনা হত, সেটা লুকিয়ে রাখা হত ঈদের দিন সকাল পর্যন্ত। পোশাক যেন অন্য বন্ধুরা দেখতে না পারে বা একই রকম কিনিতে না পারে তার জন্য প্রানান্তর চেস্টা চলত। তখন মকমলের প্যান্ট খুব চলত মনে পড়ে। ঈদে সালামি উঠত বেশ, তখন ৫০টাকাই অনেক মুল্যবান। একটু আইডিয়া দিয়ে রাখি ৯৬/৯৭ সালে গরুর মাংস ৪০টাকা কেজি, চাল ১০টাকা কেজি, ইলিশ মাছ কেজি ৫০টাকা এ রকম। চাচা মামারা ১০ টাকা করে সেলামী দিত, কেউ কেউ ৫টাকাও দিত। ঈদের দিন সকালে সেমাই খেয়ে পাঞ্জাবি পড়ে যেতাম ঈদগাহ মাঠে নামাযে। বন্ধুরা মিলে নতুন পোশাক পরিধান করে রিক্সায় ঘুরতাম রাজবাড়ী শহরে, পদ্মা পাড়ে যেতাম, কোকোনাট ফার্মে অনেক লোক ঘুরতে আসত। সালামির টাকা দিয়ে আইসক্রিম, কোকাকোলা, চিপস বা মজার খাবার কেনা হত। আরেকটা বিষয় লক্ষনীয় আমাদের সাথে সনাতন ধর্মের বন্ধুরাও ঘুরত ঈদে, এমনকি দুপুরে বাসায় আমাদের সাথে পোলাও মাংস খেত। আমরাও ওদের দুর্গাপূজার সময়ে একসাথে ঘুরতাম। আসলে সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি বজায় ছিল খুব সুন্দরভাবেই।
আর একটু বড়কালের কথা বলি, ২০০৫ সালের আগ পর্যন্ত মানে কলেজ পাশ করা সময়কাল। তখন বাই সাইকেল ছিল অনেক বন্ধুরই, সবাই মিলে সাইকেলে ঘুরতাম ঈদের দিনে। রাজবাড়ী অঞ্চলে ঈদের দিন সকালে বেশিরভাগ পরিবারে খিচুড়ি মাংস বা ইলিশ মাছ থাকত। আমি লাচ্ছা সেমাই খুব পছন্দ করতাম। দুপুরে পোলাও মাংস রান্না হত, ঈদের দিন বন্ধুদের বাসায় দাওয়াত দিত প্রায় সবাই। রাতের বেলায় টিভিতে ঈদের স্পেশাল নাটক দেখা হত।
ভার্সিটিতে ভর্তির পর ঈদ করতে বন্ধুরা সবাই গ্রামের বাসায় ঈদ উদযাপন করেছি। এ সময়ে রাজবাড়ীর অনেক বন্ধুর মোটর সাইকেল ছিল, আমরা বন্ধুরা মোটর বাইকে ১৫-২০ কিমি লং ড্রাইভে যেতাম ঈদের দিন। আশেপাশের আত্মীয়ের বাসায় যাওয়া হত। আরেকটা কথা কুরবানির ঈদে মাংস বন্টন নিয়ে দুপুর ৩/৪টা পর্যন্ত ব্যস্ত থাকতাম। বিকেলে ঘুরা হত বেশিরভাগ। যুবক বয়সেও ঈদে নতুন পোশাক সবাই কিনত বলা যায়, এটা একটা বড় উৎসব আমাদের মুসলমানদের। ছাত্রজীবনে নিজ বাসা ছাড়া অন্য কোথাও ঈদ করিনি কখনোই। জন্মভূমির টান এখনো কাজ করে অবশ্য। ঈদের সময়টা নিজ বাড়িতে থাকা চাই।
চাকুরী জীবনে প্রবেশের পর প্রতিবারই রাজবাড়ী যেতে চেস্টা করেছি। সরকারি চাকুরি সময়ে বিভিন্ন সময়ে পোস্টিং ছিল বিভিন্ন জেলায়-কুস্টিয়া, দিনাজপুর, রংপুর, ঢাকা, মাগুরা। বিবাহের পর সস্ত্রীক রাজবাড়ীতে ঈদ করেছি প্রতিবার, দুবার ব্যতিক্রম। বড় হয়ে এখন ঈদ উপলক্ষে নিজে পোশাক কেনার চেয়ে অন্যদের গিফট দেয়াতেই আনন্দ। বাবা মা ভাইবোন অন্যান্য আত্মীয়দের মাঝে সুখ বিলিয়ে দিতেই আনন্দ। বন্ধুমহলে কয়েকজন গাড়ি কিনেছে, এখন ঈদের দিন গাড়িতেই ঘুরি বন্ধুরা কয়েকজন। মহান আল্লাহ সামর্থ্য দিয়েছেন নিজে কুরবানি দিতে পারছি। এক সময়ে আমরা শেয়ারে চাচারা মিলে গরু কুরবানী দেয়া দেখেছি। বড় হবার পর এখন ছোটদের সালামি দিতে বেশ ভাল লাগে। ২০২০ সালে কোভিড মহামারীর জন্য ঈদে বাসায় যেতে পারিনি। তখন মাগুরা গণপূর্ত বিভাগের এক্সেন আমি, সরকারি নিষেধাজ্ঞার জন্য সরকারি বাংলোতে ঈদ করি। এই প্রথম পরিবার ছাড়া ঈদ করলাম, অফিসের কয়েকজন সহকর্মী আমার জন্য মজার খাবার রান্না করে পাঠিয়েছিল তাদের প্রতি কৃতজ্ঞতা। ২০২১ সালেও করোনার জন্য ঈদ বাসায় যেতে পারিনি, সেবার রংপুরে পোস্টিং ছিল। শ্বশুরবাড়ি পার্শ্ববর্তী জেলা দিনাজপুর হওয়ায় সেখানে ঈদ উদযাপন করি।
তবে রাজবাড়ী ঈদ আমি সব সময়ে উপভোগ করি, ভালবাসি। বন্ধুবান্ধব আত্মীয়-স্বজন সকলে প্রায় রাজবাড়ীতেই, শেকড়ের টান বলে কথা। সেকালের ঈদের স্মৃতি আসলে ভুলার নয়। ঈদে বাড়ি যেতে ট্রেন বা বাস জার্নিটা কিছুটা ভোগান্তি হলেও অসীম আনন্দের কথা ভেবে সব কস্ট মুছে যায়। সকলেরই উচিত পরিবারসহ ঈদ আনন্দ উপভোগ করা।
লেখক- আব্দুল্লাহ আল মামুন
নির্বাহী প্রকৌশলী, গণপূর্ত বিভাগ, দিনাজপুর