১।
রাত অনেক হয়ে গেছে। বাসায় যাবার বড় গলির সামনে এসেই তার সাথে আমার দেখা। কেমন বিদঘুটে মুখ নিয়ে তাকিয়ে আছে। তার দিকে তাকিয়েই আমার মেজাজ আরো বেড়ে গেলো। মেজাজ এমনিতেই অনেক খারাপ আজ। অফিসে প্রায় পাচলক্ষ টাকার হিসাব মেলাতে পারছিনা৷ বছরের এই মাঝামাঝি প্রান্তে এসে আমার উপরে রীতিমতো ঝড় চলে। হিসাবের খাতা মেলানো। পাই পাই করে হিসাব দেওয়া থাকে। কোথায় যে গ্যাড়াকল টা বেজেছে!! আমার বিশ্বাস কেউ একজন কোথাও ঘাপটি মেরেছে। হিসাব কিছুতেই কেনো মিলছেনা। আমার কাছে সমস্ত ডকুমেন্ট থাকে৷ কোন একটা ডকুমেন্ট পাচ্ছিনা | টেনশনে ইদানিং প্রায়ই রাত ভর হিসাব করি। একই হিসাবে যোগ বিয়োগ।ফলাফল সেই একই। গরমে ঠান্ডা লেগে গেছে৷ অফিসে বসে গলা ব্যথায় অস্থির লাগে। মনে হয় গলাই কেটে ফেলি। গরম পানি দিয়ে গল গল করতে হয়। গরম পানির পাত্র নিয়েই বাসায় ফিরছিলাম। পাত্র ভর্তি গরম পানি। কুকুরটাকে দেখে কেন জানি প্রচন্ড রাগ উঠলো। গরম পানির পুরোটাই তার গায়ে ঢেলে দিলাম। কুক কুক রকমের শব্দ তুলে কুকুরটা দৌড়ালো। আমি আধারে পথ ধরলো এখনো পনের মিনিটের পথ| দুই একবার পিছ তাকালাম কুকুরটা আসছেনা। অন্ধকার পথ বুঝে বাসায় গৌছুলাম।
২।
পরের দিনও একই অবস্থা। হিসাব মিলছেনা। মনে পরছে করিম সাহেব বছরের শুরু দিকে টাকা নিয়েছিলেন। সেই হিসাব নেই। কিছু একটা বিরাট গন্ডগোল হয়েছে। করিম সাহেবকে জিজ্ঞেস করেছিলাম। তিনি চোখ উলটে বললেন “কি সব বলেন? আমি কেন টাকা নেবো?” আমি ধীরে নিশ্বাস ফেললাম। যার রেকর্ড নেই তার কথা কোথাও তা জোড় করে বলা যায়না। এমডি স্যারকে সব খুলে বললাম। তিনি হেসে বললেন “টাকা মিলাবেন আপনি। কিভাবে মিলাবেন আপনি বুঝাবেন। তবে যদি মনে হয় কেউ অনিয়ম করেছে, চিটিং করেছে তো বইলেন৷ কিন্তু প্রমান তো আপনাকে দেখাতেই হবে” আমি সারাদিন রুমে বসে ঝিমিয়েছি। রাত বাড়তে চলে এসেছি। গলির সামনে এসে অবাক হয়ে দেখলাম কালকের সেই কুৎসিত কুকুরটা দাড়িয়ে আছে৷ মনে হলো আমাকে দেখার জন্যই দাঁড়িয়ে ছিলো। টচ মারলাম গায়ে। গায়ের একটা অংশ পুড়ে যাওয়া মনে হলো। মাংশ পুড়ে গেছে। কাল গরম পানি ঢেলে দিয়েছিলাম। মনটা একটু খারাপ হলো৷ কিন্তু এই কুকুরটা আমার এখানে কেন? প্রতিশোধ নিতে এসেছে? আমার একটু ভয় ভয় লাগলো। কুকুরটার দিকে তাকালাম। এই প্রথম চোখের দিকে। দেখতে যতই খারাপ হোক বেচারার চোখ ভর্তি মায়া। আমি হাটেতে লাগলাম। কি অদ্ভুত কুকুরটাও আমার পিছনে পিছিনে হেটে আসছে। আমি একটু থামলাম। সে পাশে এসে দাড়ালো। বাড়ী পৌছানো পর্যন্ত সে আমার সাথে সাথে হাটলো। আমি বাসার ভিতরে ঢুকে তাকালাম। সে যাচ্ছে। অনেক দূর গিয়ে কি ভেবে আবার পিছনে তাকালো। কাকে খুজছে? আমাকে??
৩।
পরের চারদিনও আমার খুব খারাপ কাটলো। হিসাব মিলছেনা। দুই তিনদিনের মাঝে আমার সব জমা দিতে হবে। জ্বর এসে গেছে। সামান্য কেরানীর চাকরী করি। পাচ লাখ টাকার হিসাব মেলাতে গেলে আমার জমি বিক্রী করতে হবে। বাসায় ফেরার সময় গলির মুখে এসে খুজলাম। গত পাচ দিন ধরেই কুকুরটা আমাকে এগিয়ে দিয়েছে। আজকেও দেবে কি? কেমন মায়া লাগে বেচারার জন্য। কিছুক্ষনের মাঝেই দেখলাম কুকুরটা আরো দুইটা কুকুরকে নিয়ে এসেছে। আজকে কি গ্রুপ ধরে প্রতিশোধ নিবে তারা? তারা কিন্তু কোন শব্দও করলোনা না। আমার চারপাশ দিয়ে হাটলো। তারপর বাসায় ফেরার পথে দুইজন সামনে দুইজন পিছনে হেটে অনেকটা আমাকে পাহাড়া দিয়ে নিয়ে এলো। বাসায় ঢুকে আমি একবার ফুচকি দিলেম। অনেক দূর হেটে যাবার পর তারা পিছ ফিরে তাকালো।
৪।
পরের দুইদিনও এমন গেলো । ফেরার সময় তারা কয়েকজন আসে। আমাকে বাসায় পৌছে দিয়ে চলে যায়। যে কুকুরটার গায়ে গরম জল ঢেলেছিলাম সে একটু বেশীই আন্তরিক। কিছুক্ষন লাফালাফি করে। পায়ের কাছে এসে গন্ধ শুকে যায়। বাসায় পৌছে দিয়ে অনেকদুর হেটে গিয়ে পিছনে তাকায়।
৫|
আমাকে ভয়ানক পরিস্থিতি থেকে বাচালো আসিফ। রুমে এসে বললো “করিম সাহেবের যে ফাইল আপনি পাচ্ছেন না সেটা আমি এনে দেবো। উনি লুকিয়ে ফেলেছিলেন। আর আমি জানি উনি কোথায় লুকিয়েছেন।“ তারপর মুখ নামিয়ে এনে বললেন “ একটা সময় ভালো সম্পর্ক ছিলো, তার অনেক জিনিসই আমি লক্ষ্য করে রেখেছি। ফাইলটাও কোথায় আছে আমি জানি।“ আসিফ আরেকটু মুখ কাছে এনে বললো “এই চোরামির জন্য আপনি শুধু তার চাকরীটা খেয়ে নিবেন। এমডি সাহেবকে বলে দিবেন। “ আমি হাসলাম , বললাম “বলবো” ।আমি ফাইল পেয়ে গেলাম। সেদিওনই কিছু করলাম না৷ বাসায় ফেরার পথে আবার কুকুরগুলো কাছে এলো৷ অসুস্থ কুকুরটার চোখের দিকে তাকালাম। আহারে কি মায়া। আমি তার দিকে তাকিয়ে বললাম “কত কি শেখার বাকী আছে মানুষের……”
৬।
এমডি স্যারের রুমে গিয়ে আমি হিসাব বুঝিয়ে দিলাম। স্যার বললেন “কোথায় জানি হিসাবে ঝামেলা হয়েছিলো? কোন চিটিং?” আমি অনেক কথাই বলতে এসেছিলাম । বললাম “স্যার একটা অবাক ব্যাপার জানেন? আমার ফেরার পথে একবার এক কুকুরের গায়ে গরম জল ঢেলে দিয়েছিলাম। প্রতিশোধ দূরে থাক তারপর থেকে অদ্ভুত এক ব্যাপার ঘটছে। এই কুকুর তার দলবল নিয়ে প্রতিদিন অন্ধকার থেকে আমাকে বাসায় পৌছে দেয়…” এমডি সাহেব আমার দিকে শান্ত চোখে তাকিয়ে বললেন “আমি কি প্রশ্ন করেছি…” আমি বললাম “ কোন চিটিং হয়নি স্যার। আমি হিসাবে ভুলে করেছিলাম…” আসিফ অনেক ক্ষুব্ধ হলো। করিম সাহেব অবিশ্বাসী চোখে তাকিয়ে রইলেন। একবার আমার কাছে এসে বললেন “জানি বড় কোন ক্ষতি করারা ধান্দায় আছেন। করেন। আমিও বসে নেই” আমি উত্তর দিলামনা। হাসলাম। অফিস থেকে ফিরে আসার সময় আমি কুকুর গুলোর জন্য কিছু বিস্কৃত কিনে নিলাম।
৭।
তারা যে খুব খুশি হলো এমন না। তবে খেলো। বিস্কুট খেলো। তারপর আর সব দিনের মতোই আমাকে পৌছে দিতে আসলো। মনে হলো পরস্পর অনেক কথা বলতে বলতে তার পৌছে দিলো। বাসায় ফিরে আমি একবার জানালা দিয়ে ফুচকি দিলাম| তারা অনেক দূর গিয়ে পিছনে তাকালো। তারপর আবার সামনের দিকে রওনা হলো।