কিন্ডারগার্টেনে স্কুল অব মিউজিক নামে একটা স্কুলে পড়তাম। স্কুলের আরো একটা নাম ছিল শিশু মনোজাগতিক বিদ্যালয়। সেই স্কুলের স্মৃতি আমার খুব একটা সুখকর নয়। ছাত্র হিসেবে খুবই সাধারন মানের ছিলাম। এমনি পড়ালেখায় যাই করি না কেন গান, অরিগামি, কবিতা আবৃত্তির মত বিষয়গুলোতে যা নম্বর আসতো তাতে রেজাল্ট তলানিতে ঠেকত।
সেই স্কুলের শেষ বছরে বিশাল এক কাজ সম্পাদন করে ফেললাম। একদিন স্কুলে যেয়ে শুনি স্কুলে নাটক হবে। শেষ বর্ষের ছাত্রছাত্রীরা অভিনয় করবে। আজকে তার অডিশন। সবাইকেই অডিশনে অংশগ্রহন করতে হবে। অডিশনের বিষয় দুইটি। হাসির অভিনয় করতে হবে তারপর কান্নার অভিনয় করতে হবে। হাসির অভিনয়ে সবাই হা হা হোহো করে পার করলেও কান্নার অভিনয় সেভাবে কারও আসছিলোই না। আমার পালা যখন আসল সবাই অবাক হয়ে দেখল চার বছর ধরে লাজুক আর ল্যাবেন্ডিশ হিসেবে পরিচিত ছেলেটি কি সাবলীল ভাবে হাসির অভিনয় তো করেছেই, কান্নার অভিনয় ও করে ফেলেছে। স্কুলের হেড মিস্ট্রেস ততক্ষনে ইউরেকা ইউরেকা বলে অন্য শিক্ষক দের ডেকে এনেছে। চেহারা ছবি ভাল বলে নাটকের কেন্দ্রীয় চরিত্র পেলাম। বীরুপতি। মোটামুটি নায়ক বলা চলে। ছোটদের নাটক বলে প্রেম জিনিসটা সরাসরি না থাকলেও হালকা প্রেম প্রেম ভাব আছে স্ক্রিপ্টে। সেই নাটকের শেষ দৃশ্যের একটা ছবি আজও সেই নায়িকাদের নস্টালজিক পোস্টে ফেসবুকে ওয়ালে ওয়ালে ঘোরে।
শিশু মনোজাগতিকের গন্ডি পেরিয়ে যখন খুলনা জিলা স্কুলে ভর্তি হলাম তখন আবিষ্কার করলাম, ছাত্র হিসেবে আমি ততটা খারাপ না। তবে প্রথম দিকে স্কুলের অনুশাসন দেখে ধাক্কার মত লেগেছিল। কথায় কথায় বেত দিয়ে পাছায় দু ঘা দেওয়ার সাথে আমি তখনও পরিচিত না। তার মধ্যে ধর্ম ক্লাশ নিতে সাক্ষাত যমদুত ইউনুস স্যারের আবির্ভাব হল। স্যার ক্লাশে ঢুকলেই পিন পতন নীরবতা। একদিন প্রশ্রাবের বেগ আটকে ক্লাশে বসে আছি, এমন সময় আমার সামনেই একজন স্যার কাছে যেয়ে বলল, “স্যার বাথরুমে যাব”। স্যার খাতা দেখায় ব্যাস্ত। খাতা থেকে দৃষ্টি না সরিয়েই বলল, “যা”। আমিও সাহস সঞ্চয় করে আস্তে আস্তে ডায়াসের সামনে যেয়ে দাড়ালাম। স্যার এইবার খাতা থেকে দৃষ্টি সরিয়ে জিজ্ঞেস করল, “কি ?” আমি কাপা কাপা গলায় বললাম, “স্যার বাথরুমে যাব” ইউনুস স্যার চোখ সরু করে বলল, “আর একজন কে পেশাপ করতে দেখলে কি তোদের নুনু খাড়া হয়ে ওঠে?” আমি দৌড়ে নিজের সিটে বসে পড়লাম। প্রশ্রাবের বেগও ম্যাজিকের মত উধাও হয়ে গেল।
তবে কিছুদিন যেতেই বুঝে গেলাম মোটামুটি বেত আর ডাস্টার থেকে গা বাঁচিয়ে চলতে পারলে জিলা স্কুল যায়গাটা খারাপ না। টিফিনে বিস্কুট ভেঙ্গে ছোঁড়াছুঁড়ি করা যায়। টেনিস বল আর গায়ে মেরে বোম্বাস্টিং খেলা যায়। তারপর ঘামে ভেজা শার্ট নিয়ে শরবতের গাড়ির সামনে দাঁড়িয়ে এক টাকার অমৃত দিয়ে গলা ভেজানো যায়। শরবতের গাড়ি আমাদের জন্য ছিল প্রাপ্তবয়স্কদের পাবের মত। নিষিদ্ধ যায়গা তবে ভিড় লেগেই থাকে। জ্যাক ডেনিয়েলস আর স্মিরনফ নামক অগ্নিজলের চেয়ে এর নেশা ছিল কয়েকগুন উপরে।
আর এক মৌসুমে স্কুলে খুব উত্তেজনাকর সময় যেত, তা হল খাতা দেখানোর মৌসুম। রেজাল্ট এর আগে স্যারেরা পরীক্ষার খাতা দেখাতেন। আমরা খাতা হাতে পেয়ে যোগ করে দেখতাম গোনায় ভুল আছে কিনা। অনেকেরই দেখতাম দু চার মার্ক বেড়ে যাচ্ছে। আমি আট বছর জিলা স্কুলে মনে হয় সত্তরের বেশি বার এই খাতা দেখা প্রক্রিয়ায় অংশগ্রহণ করেছি। কোনদিন আমার এক নম্বরও বাড়েনি। নিজের খাতা দেখার সাথে সাথে আর কে কি পেল তাই নিয়ে সবার ব্যাপক আগ্রহ থাকত। প্রথম, দ্বিতীয় হওয়ার মত ছাত্ররা দেখতাম নিজের সাথে সাথে প্রতিদ্বন্দিদের মার্কসও যোগ করে খাতায় লিখে রাখত। রেসে কে এগিয়ে আছে দেখার জন্য। আমি বরাবরই দর্শক ছিলাম। ক্লাশ ফাইভে একবার ধর্ম খাতা দেখাতে এসে এক স্যার হতাশ গলায় বলল, “একটা খাতা আমি আলাদা করে রেখেছিলাম, পরে সব খাতার মধ্যে হারিয়ে ফেলেছি। খাতাটা যার তাকে পেলে আজ কায়দা মত পিটাতাম। ওযু ভঙ্গের কারন সে লিখেছে পাদ দিলে। এরকম পঁচা কথা কেউ লেখে?”
জীবনের সবচেয়ে বিচিত্র আর রোমাঞ্চকর সময় বয়সন্ধির সময় আমাদের এসেছে এই জিলা স্কুলে পড়ার সময়েই। মেয়েদের গায়ে এক অদ্ভুত ঘ্রাণ থাকে যা বয়ঃসন্ধিতেই এসে নাকে লাগে। বয়স যত বাড়তে থাকে ঘ্রাণ পাওয়ার ক্ষমতাও তত লোপ পেতে থাকে। শুধু কবিদের মত চিরযৌবনা মানুষই সেই ক্ষমতা ধরে রাখতে পারে। কবি বন্ধু কাজি সাব্বির শরীফকে জিজ্ঞেস করে দেখতে হবে তার ঘ্রাণ নেওয়ার ক্ষমতার কি অবস্থা। তবে সেই বয়সে এই ঘ্রাণ আমাদের এতই উন্মাতাল করেছিল যে শুধু গার্লস স্কুলের পাশ দিয়ে রিকশায় বাড়ি যাওয়ার জন্য অনেকেই দুইটাকা বেশি ভাড়া গুনত। খেলাধুলা, সিনেমা, আন্তর্জাতিক রাজনীতির পাশাপাশি যৌনশিক্ষা নিয়ে আমাদের আগ্রহ তখন তুঙ্গে। আমার পাঠ্য বইয়ে তখন এসব শিক্ষা ছিল না তবে ক্লাশে এবিষয়ে নানা মতবাদ দেওয়ার লোকের অভাব ছিল না। একবার একজন বলল, “আমি ঠিক করেছি বিয়ের আগে লাগাবো না।” আমি অবাক হয়ে বললাম, “কেন?”
“বাচ্চা হয় কয়বার করলে জানিস? ত্রিশ বার। কোন মেয়ে যদি উনত্রিশ বার অন্য জনের সাথে করে এসে ত্রিশ বারের বার তোর সাথে করে, তাহলে কিন্তু ফেসে যাবি”। আমিও দুশ্চিন্তাগ্রস্থ হয়ে ভাবলাম কথায় তো যুক্তি আছে।
এইসময় অশ্লীল জোকস বলতে পারাটা আমরা খুব উঁচু মাত্রার প্রতিভা হিসেবে ভাবতাম। কোন ক্লাশে স্যার না আসলেই শুরু হত জোকসের আসর। সেসব জোকস অপ্রাসঙ্গিক বলে লিখছি না তবে একবার রিকশায় জোকস বলার সময় রিকশাওয়ালা রিকশা থেকে নামিয়ে দিয়েছিল সেই জোকস বলি। জোকস বলছিল জামি। আমি আর সনেট হলাম শ্রোতা।
“একলোকের দুই জমজ ছেলে। ছোট বাচ্চা এখনও ব্রেস্ট ফিড করে। সেই বাচ্চা দুটোর মাঝে তুমুল রেষারেষি কারন একজনের ধারনা আর একজন তার ভাগের টা খেয়ে ফেলে। রেষারেষি এমন পর্যায়ে পৌছাল যে একরাতে একজন আর একজনকে মারার জন্য যেখানে মুখ দেয় সেখানে বিষ মাখিয়ে রাখল। সকালে উঠে দেখে বাপ মরে গেছে।”
খুবই নির্ভেজাল নিষ্পাপ জোকস কিন্তু জোকস শেষ হওয়ার সাথে সাথে রিকশাওয়ালা রিকশা থামিয়ে বলে, “আপনারা নামেন, আপনাদের নিয়ে আমি যাব না।” আমরাও রিকশা থেকে নেমে রাস্তায় দাঁড়িয়ে অবাক হয়ে ভাবতে লাগলাম অশ্লীলতার স্কেলে এই জোকস দশের মধ্যে দুইও পেরোবে না। তাতেই নামিয়ে দিল!
তবে এই জামি ছেলেটার অশ্লীল গল্প বলাটা আর্টের পর্যায়ে নিয়ে গিয়েছিল। ক্লাশে যখন তাদের ভাড়াটিয়া হুজুর তার বৌয়ের সাথে জোহরের নামাজের পরে কি কি করে তাই নিয়ে গল্প ফেঁদে বসত তখন চারপাশে শ্রোতার ভিড় লেগে যেত। প্রতিবার সে জানালের ফাঁক দিয়ে নাহয় দরজার ফুটো দিয়ে সব দেখে ফেলত। নিতান্তই বানোয়াট গল্প জেনেও আমরা খুব মনোযোগ দিয়ে শুনতাম। ক্লাশের নিতান্ত ভদ্রছেলে গুলো যারা নিজেদের ইমেজ রক্ষা করার জন্য সরাসরি গল্পের আসরে যোগ দিতে পারছে না তারাও কাছাকাছি কোন বেঞ্চে বসে মুখ ঘুরিয়ে কান খাড়া করে শুনত।
এইসব গল্প আর ইমাজিনেশন কে মনিটরের পর্দায় এনে দিয়েছিল আমার যে মহাপুরুষ বন্ধু তার নাম তাপস। ক্লাশ এইটে থাকতে সে কিভাবে কিভাবে দোকান থেকে নীল সিনেমা ভাড়া করা শিখে গেল। তিনদিন এর ভাড়া দশটাকা একটা সিডির। এই তিনদিনে সে নিজে দেখে আরও দুই জনকে ভাড়া দিত দশটাকা করে। প্রতি সিডিতে নেট লাভ দশটাকা। প্রথম যেদিন সিডি নিয়েছিলাম ইংলিশ গ্রামার বইয়ের ভিতরে করে, বাসায় ফেরার পথে সারা রাস্তা সে কি উত্তেজনা। বাসায় ফিরেই দরজা আটকে পড়ার বাহানায় দেখে ফেললাম এত জল্পনা কল্পনার সেই আকাংক্ষিত লীলা খেলা। এত লালচে একটা সিনেমার নাম কেন নীল সিনেমা হল ব্যাপারটা অবাক করেছিল সেদিন। ইন্টারনেট আসার আগ পর্যন্ত তাপসের মাধ্যমে দুষ্টু সিনেমা দেখা চলেছিল বেশ কিছুদিন। আমি তার সবচেয়ে কাছের বন্ধু হওয়া স্বত্ত্বেও কোনদিন এক টাকাও ডিসকাউন্ট ছিল না।
তবে তাপসের মাধ্যমে যে শুধু নীল ছবিই দেখেছি তা না। বাংলা সাহিত্যের সাথে আমার পরিচয় তাপসের মাধ্যমে। সে সময়ে হুমায়ুন আর জাফর ইকবালের কোনও বই ছিল না যা ওর কাছে ছিল না। বাসায় মোটামুটি ছোটখাট লাইব্রেরী ছিল। সেই লাইব্রেরীতে ছোটদের বড়দের যেকোন বিষয়ের কিছু না কিছু বই ওর ছিল। একবার আমাকে পড়তে দিল বাড়িতে বাচ্চা প্রসব করানোর উপর লেখা একটি বই। আমি অর্ধেক পড়ে উৎসাহ না পেয়ে ফেরত দিয়ে দিলাম। এতসব বইয়ের প্রভাবে কিনা জানি না তাপস সারাদিন রাজনীতি, ধর্ম, সমাজ, অর্থনীতি এইসব নিয়ে খুব ভারী ভারী কথা বলত। আমিও ওর সাথে থেকে ক্লাশে সবার মধ্যে নিজেদের খুব ম্যাচিউর মনে করতাম।
আর একটা জিনিস খুব প্রচলিত ছিল তখন তা হল অদ্ভুত নামকরন। সবারই নামের আগেপিছে কিছু একটা জুড়ে দেওয়া ছিল। অনেকের এই নামগুলো এতই জনপ্রিয় হয়েছিল যে আসল নাম সহজে মনে করতে পারতাম না। একটা ছেলে ছিল সুব্রত। শর্ট লেগে ফিল্ডিং করত। তীব্রগতির বল আটার মত তার হাতে গেঁথে যেত। দৃষ্টিনন্দন সব ক্যাচ নিত বলে তার নাম হল আটু। কিছুদিন আগে এক কনফারেন্স কলে তার সাথে কথা হল। শুরুতেই ক্যামন আছ আটু বলতে যেয়ে থেমে গেলাম। তবে কিছুতেই তার নাম মনে করতে পারলাম না। শেষে কি অবস্থা বন্ধু দিয়েই কাজ সারতে হল। এরকম আরও একবার হয়েছিল, বয়লারের আসল নাম যে ফেরদৌস মনে করতে পারিনি বলে দুই বছর পর রাস্তায় দেখে তাকে ডেকে কথা বলা হয়নি। ক্লাশে রুবেল ছিল দুইটা। একটা হাফপ্যান্ট রুবেল কারন সে হাফপ্যান্ট পরে রাস্তায় ঘুরে বেড়াত, আর একজন ছিল গুদেল। এই নামের সারমর্ম আমি আজও জানি না। বন্ধুর জন্মদিনে চাইনিজ খেয়ে বমি করে একজনের নাম হয়েছিল বমি জিমি। ক্লাশে হস্তমৈথুন করে ক্লাইমেক্স ঘটানোয় মামুন হয়ে গেল মাল পড়া মামুন।
(চলবে।।)
Juat awesome…👍😍
Tui kv valo khela dhula koris, kv moja kore kotha bolte paris but lekha ta je valo koris eita jantam na!!! 🤔🤔
Rafin asolei osomvob valo kheladhulay. Lekhay je eto valo ke janto?!