হেরে গেলি মাসুম

হেরে গেলি মাসুম

Pic Credit: Mithail Afroze Chowdhury

মাসুমের কাছে আমি হেরে যাচ্ছি সেই ছোট থেকেই। ক্লাস ফাইভের কথাই বলি। মাসুমের ক্লাসের  ফার্স্ট বয়, আমি থার্ড। বৃত্তি পরীক্ষার সময় খুব করে পড়লাম । আমার বৃত্তি পেতে হবে। একই পাড়ায় থাকি। মাসুম পেলো আর আমি পেলামনা তাহলে খারাপ দেখায়। বৃত্তির ফলাফলের দিন খুব কষ্ট পেলাম। আমি বৃত্তি পাইনি, মাসুম ট্যালেন্ট পুলে পেয়েছে। বাবা বললো, “মাসুমের গা ধোয়া পানি খেয়ে আয়।” মাসুমের “গা ধোয়া পানির কথা ভাবলে বমির মতো হয়। আমি চুপ করে থাকি।

মাসুম ভালো ক্রিকেট খেলে, আবৃত্তি করে, আমার সে সব ও হয়না। যা একটু পড়ালেখা পারি, তাও মাসুমের চেয়ে অনেক খারাপ। ক্লাস এইটে বৃত্তি পরীক্ষার আগ আগ দিয়ে মাসুমের হঠাৎ করে জন্ডিস হলো। আমি একটু খুশীই হলাম। দিন-রাত পড়তে শুরু করলাম। দেখা যাক এবার। মাসুম জন্ডিস নিয়েই পরীক্ষা দিলো। আমিও দিলাম। আমি পেলাম না, আবারো মাসুম পেলো। বাবা চিৎকার করে উঠলো, “ঘাস খাস নাকি তুই! মাসুমরে দেখ। অসুস্থতা নিয়ে পরীক্ষা দিলো ছেলেটা। যা পোলাটার গা ধুইইয়া পানি নিয়ে গিলে খা।” আমি চুপ করে বসে রইলাম। মন ভেঙ্গে যাচ্ছিলো। সবচেয়ে অবাক ব্যাপার এই যে নিয়মিত হেরে যাওয়া, ভিতরে ভিতরে প্রবল প্রতিযোগিতা, তবু মাসুমের সাথে আমার এক ধরনের সম্পর্ক থাকেই। মানুষ পরাজিত জনের সাথে বন্ধুত্ব রাখতে ভালোবাসে। মাসুমের সাথে তাই আমার তেমনি এক অধীনস্ত-সুলোভ বন্ধুত্ব চিরকাল। আমার খারাপ লাগতো না এই সম্পর্ক। হয়তো কোন কথা উঠেছে দুজনার মাঝে, মাসুম আমার কাছে শুনতে চাইতো আমার মত। আমি কিছু বলছি আর বুঝতে পারছি আমার মত যতই যুক্তির হোক না কেনো, মাসুম সেটা হেসে উড়িয়ে দিবে। তাই হতো শেষ পর্যন্ত। মেট্রিক পরীক্ষায় মাসুম বেশ ভালো ফলাফল করে বসলো, আমি কোন রকমে ফার্স্ট ডিভিশন। ততদিনে মাসুম রাজপুত্রের মতো চেহারার অধিকারী হয়ে গেছে। তাকে মানুষ দূর থেকে তাকিয়ে তাকিয়ে দেখে। ঈর্শ্বানিত হবার মতো তার দেহ। সবাই বললো ঢাকায় যেতে। মাসুম ঢাকা যাবেনা। সে মফস্বলে থেকেই ইন্টার পরীক্ষা দিবে। তার শখ ঢাকা ভার্সিটিতে পড়বে। মাসুম এক ভোরে এসে আমাকে বললো, “চল একসাথে ‘শহিদ স্মৃতি কলেজে’ ভর্তি হই।” আমাদের কলেজ জীবন শুরু হলো।

কলেজ জীবনে আসলে আমার সাথে মাসুমের আসল লড়াই শুরু হয়ে গেলো। খুব অদ্ভুত ভাবে। লড়াই তাকে একতরফাও বলা যায়। মাসুমতো জানতো না, কি একটা লড়াই হচ্ছে আমাদের মাঝে। আমি একাই লড়ে গেলাম, হেরেও গেলাম। কি কষ্টকর সে পরাজয়!

মৌসুমীর সাথে প্রথম দেখার স্মৃতি আমার পুরো মনে আছে। ফাষ্ট ইয়ারের ক্লাস কেবল শুরু হয়েছে। বাংলা ক্লাস নেন নিবেদিতা ম্যাডাম। কিন্নর কন্ঠে মজিদের গল্প পড়ান। ম্যাডামের ক্লাস মিস করতে মন চায়না। বাংলা ক্লাস আমার খুব ভালো লাগে। এক দিন তড়িঘড়ি করে ক্লাসে ঢুকছি। দেরী হয়ে গেছে। দেরি করে ঢুকলে ম্যাডাম খুব আহত চোখে তাকিয়ে থাকেন। ম্যাডামের আহত চোখ দেখতে ভালো লাগে না। ক্লাসে ঢোকার ঠিক আগ মুহুর্তে দেখলাম শুকনা করে খুব মিষ্টি একটা মেয়ে দাঁড়িয়ে আছে ক্লাসের দরজার এক পাশে। সাদা জামা পরা, লাল লাল ফুল আকা জামাতে। কি শান্ত-সরল চেহারাটা। আমি ইচ্ছে করেই ক্লাসে না ঢুকে দাঁড়িয়ে রইলাম ক্লাসের দরজার পাশে। মনে হচ্ছিলো এই মেয়েটা আমাকে কিছু জিজ্ঞেস করলেও করতে পারে। মনে মনে অপেক্ষা করছি। মৌসুমী আমার দিকে একবার তাকালো, চোখ নামিয়ে নিলো। আমি তখনো স্থির হয়ে তাকিয়ে আছি। চোখ নামাতে ইচ্ছে করছে না। মৌসুমী আবার তাকালো আমার দিকে তারপর একটু এগিয়ে এসে জিজ্ঞেস করলো, “এটা কি ফার্ষ্ট ইয়ার। আমি নতুন ভর্তি হয়েছি।“ আমি একটু ধাতস্থ হলাম মনে হয়। বিরবির করে বললাম-
-হ্যা এটা ফার্ষ্ট ইয়ার।“ মৌসুমী কি বুঝলো কে জানে। গলায় অসম্ভব আন্তরিকতা নিয়ে বললো-
-আচ্ছা আমার নাম মৌসুমী।
-ও আচ্ছা।” কথাবার্তা এই পর্যন্তই। নিজের নাম বলার মতো ভদ্রতাও ভুলে গিয়েছিলাম। আমি প্রথম দেখাতেই মৌসুমীর প্রেমে পরে গিয়েছিলাম? লাভ আট ফার্ষ্ট সাইট! কে জানে? হয়তো।

মৌসুমী খুব অল্প সময়ের মাঝেই ক্লাসে জায়গা করে নিলো। ক্লাসের সব আড্ডা মৌসুমীকে ঘিরে হয়। মৌসুমী অসম্ভব সুন্দর করে কথা বলে। গুছিয়ে বলে। উচ্চারন ভঙ্গি খুব সুন্দর। আমি মুগ্ধ হয়ে মৌসুমীর কথা শুনি। আমার কথা বলার ভঙ্গি ভালো না। আমি চুপ করেই থাকি বেশীর ভাগ সময়ে। মৌসুমী সবার সাথেই বন্ধুত্ব করতে পারে। কাউকেই সে আঘাত দিতে চায় না। এক বৃষ্টি্র শেষে সন্ধ্যায় আমি বুঝে গেলাম আমি মৌসুমীর প্রেমে হাবুডুবু খাচ্ছি। সন্ধ্যায় মৌসুমী আর আমি প্রাইভেট পড়ে বের হয়েছি। সেই প্রথম শুধু আমি আর মৌসুমী। এক সাথে পাশে হাটা। আমার ভিতরে প্রচন্ড এক অস্বাভাবিকতা। বৃষ্টি শেষের আলো এসে পড়েছে মৌসুমীর চোখে মুখে। হলুদ রঙের একটা জামা পরেছে মৌসুমী। কি অপরুপ যে তাকে লাগছে। মৌসুমী আমার দিকে তাকিয়ে বললো, “কোথাও একটু চা খেতে পেতাম।” আমি চারপাশে চায়ের দোকান খুজছি। পাগলের মতো। এই মুহুর্তে চায়ের দোকান হচ্ছে আমার কাছে পৃথিবীর সব চেয়ে কাংখিত জিনিস। মৌসুমী আবার বললো, “না বাবা। সন্ধ্যায় দোকানে চা খেলে মানুষ খারাপ বলবে। বাদ দেও।” মৌসুমী চলে যাবার পরে কেমন যেন স্থির হয়ে বসে রইলাম অনেকক্ষন। চায়ের তৃষ্ণা আমারো ছিলো। কিন্তু সেই তৃষ্ণাকেও অচল করে দিয়ে কিসের এক বিষন্ন তৃষ্ণা আমাকে আকড়ে ধরলো। বাসায় শুয়ে অনেকরাত পর্যন্ত সেই তৃষ্ণা আমাকে নাড়িয়ে গেলো। আমি নিশ্চিত হয়ে রইলাম আমি ঋনী হয়ে আছি, খুব বেশী ঋনী।

মৌসুমীর সাথে ততদিনে মাসুমের বন্ধুত্বও খুব জমে গেছে। যেখানেই যায় দুইজন একসাথে। দুজন কত অনুষ্ঠান করে বেড়ায়। সব আড্ডাতে তারা মধ্যমনি। কলেজে বিতর্ক করলো এক সাথে চ্যাম্পিয়ন হয়ে এলো। ওদের দুজনকে মানায় ও খুব চমৎকার। সবাই বলে ওদের পাশাপাশি ভালো লাগবে। আমি শুনি, মনে মনে মানিও। মাসুমই মৌসুমীর জন্য যোগ্য, আমি নই। কলেজে সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানে ওরা একসাথে আবৃত্তি করলো “কথপোকথন”। কি অসাধারন পারফর্মেন্স! আমি দূর থেকে জোড়ে হাতে তালি দেই। মৌসুমীর প্রতি আমার ভালোবাসা যত বাড়তে থাকে আমি জানি ততই ক্ষুদ্র হতে থাকি তার প্রতি। ভালোবাসা আমাকে তার পাশে দাড় হবার সাহস দেয় না, বরং দূর থেকে তাকে ভেবে বিষন্ন রাত্রি পার করার বিপন্নতা তৈরী করে। মনে হয় আমি নই, মাসুমকেই মানায় মৌসুমীর পাশে। আমিতো চির পরাজিত। আমি থাকবো দূরে দূরে, দূর থেকে তার ভালো থাকা দেখবো। তার কাছে আমার কি কাজ?

মাসুম-মৌসুমীর প্রেম ক্রমশ স্বীকৃতি পেয়ে গেলো। কলেজের মানুষের আলোচনার বিষয় হয়ে উঠেছে। ওদেরকে সব জায়গাতেই একসাথে দেখা যায়। প্রায় রিক্সা নিয়ে কোথাও হারিয়ে যায়, আমি হারিয়ে যাওয়া পথের দিকে তাকিয়ে থাকি। মাঝে মাঝে দূরে কোথাও গেলে আমাকেও সাথে নিতে চায়। আমি এড়িয়ে যাই। মাসুমের খালাতো বোন মহুয়ার সাথে তার প্রেমের একটা গোপন কথা শুনেছিলাম। একদিন মাসুমকে জিজ্ঞেসও করলাম। মাসুম বললো– “মৌসুমী আসার পর সেসব কবেই হারিয়ে গেছে জীবন থেকে…” আমি মনে মনে খুশী হই। এমনিতো হওয়া উচিৎ। মাসুম শুধুই ভালোবাসবে মৌসুমীকে। আর কাউকেই নয়। মৌসুমীকে আরেকজন মানুষ ও খুব ভালোবাসবে। মৌসুমী তার কথা কোনদিনই জানবেনা।

কলেজ পার হয়েই মাসুম ঢাকা ভার্সিটিতে ভর্তি হলো। মৌসুমীও পুরো পরিবার নিয়েয় ঢাকা চলে গেলো। মৌসুমীর একবার ঢাকার যাবার জন্য কাউকে প্রয়োজন হলো। মৌসুমী আমাকে অনুরোধ করলো তার সাথে যাবার জন্য। আমার এই ভীষন পরাজয়ের জীবনে সেই ট্রেন জার্নিই ছিলো স্বপ্নের মতো শিহরনময়। পাশে বসে আছি চুপ হয়ে। প্রতি মুহুর্তে মনে হচ্ছে কি করি! কি করি! কি করলে মানূষটাকে আরো ভালো রাখা যায়। এক সময় ক্লান্ত হয়ে গেলাম। এই মেয়েটা কোনদিনই জানবেনা তার পাশের হৃদয়টা কী যন্ত্রনায় ছটফট করছে। আমি হঠাৎ দীর্ঘশ্বাস ফেললাম। মৌসুমী আমার দিকে তাকিয়ে বললো-
-দীর্ঘশ্বাস কেনো?” আমি শুকনো হাসি হাসলাম।
-তুমি সবসময় এমন মন খারাপ করে থাকো কেনো বলতো?
-কই নাতো?
-তুমি কি কাউকে ভালোবাসো আবির?” আমি হাহা করে হেসে উঠলাম। তারপর হাল্কা গলায় বললাম-
-ভালোবাসতে যা যা দরকার তার কোনটাই নেই আমার কাছে।
-কি কি দরকার?”

কি ভীষন মমতা ভরা গলায় সে বললো, “কি কি দরকার?” এক মুহুর্তের অন্য মনে হলো সে বোধ হয় সব জানে। সব কথা। মৌসুমী বোধ হয় কোন মানুষ নয়, অন্তর্যামী। আমি মৌসুমীর চোখের দিকে তাকিয়ে আছি, সেও আমার দিকে তেমনি তাকিয়ে আছে। ট্রেন থেমে গেছে। হুইসেল বাজছে। আমার জীবনের সব ট্রেন গন্তব্যে পৌছুনের আগেই থেমে যায়। কেনো?

সেই মৌসুমীকে শেষ দেখা। মাসুমের সাথেও আর যোগাযোগ রাখিনি। মাসুম কয়েকবার চিঠি দিয়েছে। নাম্বার চেয়েছে। উত্তর দেয়নি। তাদের কে দূরে ঠেলেছি, পাশে রেখেছি বেদনাকে। বেদনার জায়গাটাকে কেমন যেনো অহংকারের মতো মনে হয়। এই অহংকার, অভিমানকে ভালোবেসেছি। অভিমান টিকে থাকা মানেই মৌসুমীর টিকে থাকা, আমি মৌসুমীকে হারাতে চাইনি কখনোই। হারাতে চাইনি বলেই দূরে থাকার সিদ্ধান্তে অটল ছিলাম। বুঝি ওদের সাথে আর কোনদিন দেখা হবেনা। মনে মনে একটা দীর্ঘশ্বাসের মতো হয় আবার একটা নিশ্চয়টার সুখও বোধ করি। এই দেখা না হওয়ার পুরো ব্যাপারতাই বোধ হয় এক ধরনের নিশ্চয়তা।

দূরে দূরে থাকলেও ওদের খবর কানে আসতো। শুনে ছিলাম অনার্স সেকেন্ড ইয়ারেই ওরা বিয়ে করে নিয়েছিলো। পাশ করে মৌসুমী সরকারী অফিসার হয়েছিলো আর মাসুম বড় মাল্টিন্যাশনাল কোম্পানিতে চাকরী নিয়ে খুব ব্যস্ত হয়ে গিয়েছিলো। ওরা ভালো আছে।

বোটানি থেকে অনার্স মাষ্টার্স শেষ করে আমি এলাকাতেই থাকবো ভাবলাম। বাবার মনোহারী দোকান আছে কয়েকটা। কিছু টাকা ধার নিয়ে একটা বড় নার্সারি খুলে ফেললাম। নার্সারির ব্যাবসার সাথে আরেকটু বেশী মনযোগী হলাম। আমার দিন ভালোই কাটতে থাকলো। নার্সারিটাকে আমার স্বপ্নের মতো মনে হয়। হাজারো রকমের ফুলের গাছে ভরা। শীতের দিনগুলোতে আমার নার্সারি রুপে অনন্যা হয়ে ওঠে। কত রঙ বেরঙ্ এর ফুলই যে ফোটে। কতসব ধরনের রঙের, কত গন্ধের ফুলেরা সব। ফুল গাছ গুলোর মাঝে বসে মাঝে মাঝেই মনে হয় আমি বোধ হয় মৌসুমীকে ভুলেই গেছি। পরদিন শীতের সকালের কমল রোদ দাঁড়িয়ে থাকে গ্যাদ্যা ফুলের কোল ঘেষে। মনে পরে এক বৃষ্টির সন্ধ্যায় হলুদ জামার মৌসুমীর কথা। মন ভালো হয়ে যায়। আমি তাকে ভুলিনি!

বাসা থেকে প্রায়ই বিয়ের কথা ওঠে। আমিও বিয়ে করবো বলে মনে মনে ভাবি। একটা দুঃখী মেয়েকে বিয়ে করবো। এক জীবন দিয়ে যার দুঃখ দূর করে দেবো। এক জীবনে যদি একজনার দুঃখই দূর না করলাম তো কিসের জীবন।

আমার নার্সারির ব্যবসা ফুলে ফেপে উঠে। বেশ লাভ হয়। পাশেই একটা ঔষধি গাছের বাগান করার ইচ্ছে। ঔষধি গাছ সংগ্রহের আশায় ঢাকায় গেলাম। নানা জায়গায় ঘুরছি। চারা দেখছি। খামার বাড়ির পাশে একজায়গায় শুনলাম ভালো মানের চারা পাওয়া যায়। সেখানে ঘুর ঘুর করছি হঠাৎ শুনি কেউ যেন তীব্র স্বরে ডাকছে,“এই আবীর…আবীর!” পিছ ফিরে তাকালাম। প্রাইভেট কার থেকে ডাকটা আসছে। কাছে গিয়ে অবাক হলাম। মাসুম! মাসুমকে কতদিন পর দেখলাম। মোটা হয়ে গেছে অনেক। মাসুম গাড়ী থেকে নেমে আমাকে জড়িয়ে ধরলো।
-কিরে তুই? তুই এমন কেন? কোন যোগাযোগ রাখিসনি।
-এইতো। হঠাৎ ব্যবসা…
-আরে তোর চাপাবাজি থামা…তুই আসলেও অসামাজিক…ঢাকায় কি?
-এই কিছু চারা গাছ খুজতে আসা। আজকেই চলে যাবো…
-হ্যা দেখাচ্ছি তোর চলে যাওয়া। চল বাসায় চল।

আমার হাজার আপত্তি ও মাসুমকে থামাতে পারলোনা। আমাকে নিয়ে যাবেই। আমার মনেও কি কোন গোপন ইচ্ছে ছিলো!! মাসুমের গাড়ীর চেয়েও বেশী গতিতে চলছে আমার মন। হায়! আমি কোথায় যাচ্ছি।

মাসুমের নিজের ফ্ল্যাট দেখে মুগ্ধ হয়ে গেলাম। মাসুম আমাকে নিয়ে সব দেখালো, ভিতরের ঘরে বসালো।
-মৌসুমীর অফিস ছুটি হতে হতে পাচটা… বুঝলি… আজ আসলে যা আড্ডা হবেনা… কতদিন পর দেখ…

মাসুম একে একে তার গল্প বলছে। সবই বিজয়ের গল্প। সর্ব খেলায় বিজয়ী মাসুমকে দেখছি দুই চোখ ভরে। বিকাল থাকতে থাকতেই মৌসুমী এলো। আমাকে দেখে চিৎকার করে উঠলো-
-আরে এই তাকে কোথা থেকে নিয়ে আসলে? কি আজিব মানুষ রে ভাই… এভাবে হাওয়া হয়ে যায় কেউ?…

আমি মৌসুমীকে দেখছি। আগের মতোই আছে। একটু মুটিয়ে গেছে। আমি চোখ ছড়িয়ে নিতে পারছিনা। যাকে মনের দেখা দেখবো বলে চোখের বাইরে রাখতে চেয়েছিলাম সে যখন চোখের কাছেই আসলো তখন মন থেমে রইলোনা। কত স্মৃতি মনে পরছে। সন্ধ্যার পর অনেক গল্প হলো। খাবার সময় মাসুম একটু বারান্দায় গিয়ে দাঁড়িয়ে রইলো, এই ফাকে হঠাৎ মৌসুমী আমাকে জিজ্ঞেস করলো-
-তুমি না একবার বলেছিলে ভালোবাসতে যা লাগে তা তোমার নেই… সত্যি কি তোমার সেসব ছিলো না আবীর…?” আমার চোখের দিকে সোজা তাকিয়ে প্রশ্ন করেছে মৌসুমী। আমিও তাকিয়ে রইলাম। বেশীক্ষন তাকাতে পারলাম না। চোখ নামিয়ে নিলাম।
-বাদ দাও মৌসুমী। অল্প বয়সে কত কি না ভেবেছি!” মৌসুমি বলে উঠলো, “অল্প বয়সের চিন্তা গুলিই ভালো। অল্প বয়সে মনে কথা ঠিক মতো বলে দিলে কারোর জীবনই হয়তো পচে যায়না।” মৌসুমী উঠে চলে গেছে। এই এক কথায় সে কি বোঝালো আমি বুঝলাম না। বুঝতে আমি চাচ্ছিলাম ও না। আমি ভাবছিলাম কত আগে বাসা ছেড়ে যেতে পারি। কল্পনায় যে আকাংখিত নারী, সে সেখানেই থাক। মাটির পৃথিবীতে নেমে এলে বড্ড বেশি ঢুলো ময়লা লেগে যায়। আমি আর মৌসুমীকে পৃথিবীর ঢুলোতে মাখিয়ে দিতে চাই না। সে থাকুক অনেক দুরের মাঠের কল্পনার আলো হয়ে।

সেদিনই সেই বাসা থেকে আসতে পারলাম না। পরের দিনেও নয়। একটা কাজে রাত হয়ে গেলো। মাসুম ডেকে নিয়ে গেলো বাসায়। সে সন্ধ্যায় মাসুম নেশার বোতল খুললো। মৌসুমিও দেখলাম গ্লাস ভরে বসে গেছে। অনেকটা সময় তারা ভালোই ছিলো। হঠাৎ তৈরী হলো কথার আক্রমন। সে বড় ভয়াবহ আক্রমন! আমাকে মাসুম হাসি মুখে বললো, “মহুয়াকে মনে আছে? মনে নেই? ঐ যে আমার খালাতো বোন। ছোটবেলায় ভালোবাসতাম আর কি! তোর বন্ধুর তাকে নিয়ে শুধু সন্দেহ।“ মাসুম এক মনে বক বক করছে। মৌসুমিও চুপ নেই। সে চেচিয়ে বলছে, “ইউ চিট। তুমি মহুয়ার সাথে নিয়মিত যোগাযোগ রাখো। তাই নয় কি? আমি আবিরকে দেখাবো তোমাদের প্রেম পত্র?” মাসুম হাহা করে হাসছে। মৌসুমি বলেই যাচ্ছে, “তোমরা হোটেলও থেকেছো, থাকোনি? তুমি কোনদিন আমাকে ভালোবেসেছো? তোমার দরকার ছিলো একটা সুন্দর বউ, সাথে শ্বশুরের টাকা। তুমি কোনদিন মহুয়া থেকে আলাদা ছিলে…” মাসুম আরো উচু গলায় কথা বলতে শুরু করেছে। আমার খুব অস্বস্তি লাগছিলো। আমি যে তাদের পরিবারের বাইরে একজন সে কথা তাদের মনে নেই? নাকি এই অংশটা দেখানোর দরকার ছিলো খুব। মৌসুমী চাচ্ছিলো আমি এই অংশুটুকু জেনে যাই? কেন চাচ্ছিলো? কেন চাচ্ছিলো?? কেন??

আমি আর শুনতে পারছিলামনা। কষ্ট হচ্ছিলো খুব। দ্রুত বারান্দায় চলে গেলাম। কেমন একটা চাপা কষ্ট আচ্ছন্ন করে রেখেছে আমাকে।পাশের রুমে মাসুম মৌসুমীর গলার অশ্রাব্য কথা শোনা যাচ্ছিলো। আমি আরেকটু দূরে গিয়ে ভাঙ্গা একটা চেয়ারে বসে পড়লাম। বাইরে বৃষ্টি হচ্ছে ঝিরি ঝিরি। গ্রিলের ফাক দিয়ে বৃষ্টির ঝাপটা আমার গায়েও পড়ছে একটু একটু। সেই ঠান্ডা পরিবেশে হঠাৎ মনে হলো, আমি যেন আর পরাজিত কেউ নই। আমি বরং রাজার রাজা। সারা পৃথিবী আমাকে কুর্নিশ করছে। আমিই আজ রাজা, ভাঙ্গা এই চেয়ারটাই যেন ময়ুর সিংহাসন কেনো না আমিই মৌসুমীকে ভালোবেসেছিলাম। আমিই মৌসুমীকে ভালোবেসে ছিলাম। মাসুম নয়। শুধু মাত্র আমিই মৌসুমীকে ভালোবেসেছিলাম। মনের ভিতর প্রথমবারের মতো এক প্রতিশোধ পরায়ন আবির ক্রূর হাসি হেসে ফিস ফিস করে বলে উঠলো- “তুই হেরে গেছিস মাসুম… একদম হেরে গেছিস।”

আমার অন্য লেখা পড়ুন

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here

Reviews

Popular Articles