আমার ছেলেবেলা মোটেও সাদামাটা ছিল না। আমি নানা বাড়িতে থেকে মানুষ। বৃহস্পতিবার বিকেল থেকেই চৌদ্দ পনের জনের গ্রুপ সক্রিয় হত যেটা শনিবার সকাল পর্যন্ত থাকত। আমি নিজে খুবই শান্তশিষ্ট স্বভাবের হলেও এইসব দুরন্ত খালাতো মামাতো ভাই বোন আর প্রতিবেশীর কারণে রোমাঞ্চের অভাব ছিল না। কোন এক কারণে গতানুগতিক খেলাধুলায় আমাদের বেশিক্ষণ ভাল লাগত না। তখনি কারও মাথায় সেই খেলায় রোমাঞ্চকর সংস্করনের উদ্ভব হত। কিছু উদাহরণ দিলে ব্যাপারটা পরিষ্কার হবে।
ঘুটঘুটে লুকোচুরি
লুকোচুরি মনে হয় খেলেনি এমন কেউ নেই। কিন্তু আমাদের লুকোচুরি খেলা হত বধ্য ঘরে। স্টোর রুম টাইপের ঘরে যেখানে লুকানোর যায়গার অভাব নাই, সেখানে খেলা হবে। যে চোর সে ঘরের বাইরে যেয়ে অপেক্ষা করবে। ভিতরে সবাই লুকিয়ে পড়লে একজন ঘরের বাতি নিভিয়ে দেবে। সেই ঘুটঘুটে অন্ধকারে চোর ঘরে ঢুকে সবাইকে খুজবে। এই খেলার যে টান টান উত্তেজনা তার সাথে স্বাভাবিক লুকোচুরি খেলার কোন তুলনা হয় না। কতবার যে চালের বস্তা বা তেলের ড্রাম কে লুকিয়ে থাকা মানুষ মনে করে এক টিপ দুই টিপ দিত। এই খেলার কিভাবে ইতি ঘটল তা নিয়ে একটা মজার স্মৃতি আছে। আমি গ্রুপে সবার ছোট হওয়ায় আমাকে এমন যায়গায় লুকানো হত যেখানে বড়রা লুকাতে পারত না। একবার যে ঘরে খেলা হচ্ছে তার দরজার পাশেই আলমারি। আমাকে বলা হল আলমারির উপরে থাকতে। চোর ঘরে ঢুকলেই লাফিয়ে পড়ে তিলো দিতে হবে। কাউন্ট ডাউন চলছে। আমিও প্রচণ্ড উত্তেজনা নিয়ে আলমারির উপরে ব্যাঙ এর মত বসে আছি। কপাল খারাপ ছিল ওইদিন। বাসার বুয়া কোন এককাজে চোর ঢোকার আগেই ঘরে ঢুকে পড়ল। লাফ দেওয়ার কয়েক মিলি সেকেন্ড পরেই বুঝতে পারলাম যা হতে যাচ্ছে তা ঠিক হচ্ছে না। কিন্তু তখন আর কিছু করার নাই। নাইন পয়েন্ট এইট মিটার পার সেকেন্ড স্কয়ারের তখন মাটির দিকে যাচ্ছি আমি। খুব সম্ভবত কাঁধ বরাবর পড়ে ছিলাম। মাটিতে শুয়ে শুধু শুনলাম “ও আল্লাহগো”। এরপর লাইট জালানোর পর দেখা গেল বুয়া মাটিতে শুয়ে গোঙাচ্ছে। সেইদিনের মত খেলা ওইখানেই শেষ। এরপর বড়দের বেরসিক নিষেধাজ্ঞায় খুব বেশি খেলা যায়নি।
ঢেঁকি – রোলার কোস্টার সংস্করণ
এই খেলার জন্য প্রথমে খড়ের গাদা থেকে খড় টেনে টেনে নামিয়ে বিছাতে হত। এরপর একটা খালি ঠেলা গাড়ি ঠেলে তার উপর আনা হত। দশ বার জনের একটা দল ঠেলা গাড়ির উপর এমনভাবে বসত যাতে দুইপাশে সমান ভার পড়ে। এরপর খেলা শুরু হত। পালের গোদা টাইপের একজন মাঝ বরাবর দাঁড়িয়ে একবার ঠেলা গাড়ির একপাশে ভর দিত আবার আর একপাশে ভর দিত। এতে ঠেলাগাড়ি একবার এদিক আর একবার ওইদিক আছড়ে পড়ত। প্রতি দুই তিন বারে কেউ না কেউ ছিটকে খড়ের বিছানায় পড়ত। শাস্তি স্বরূপ তাকে তিন চার মিনিট দর্শকের ভূমিকা পালন করতে হত।
প্যাকেজ নাটক
সেই বয়সের মহা মহা আবিষ্কারের মধ্যে অন্যতম হল টেপরেকর্ডারের লাল ডট দেওয়া বোতামে চাপ দিলে যে সব কথা রেকর্ড হয়ে যায় তা বের করা। প্রচণ্ড বিস্ময় নিয়ে প্রথমে কিছুদিন অর্থহীন শব্দ আমরা রেকর্ড করে শুনলাম। এরপর একজন প্রস্তাব দিল চল নাটক বানাই। অডিও নাটক। নাটকের চরিত্ররা যার যার ডায়লগ বলবে। সেগুলো রেকর্ড করে পরে শোনা হবে। এডিটিং এর সুযোগ নাই। তাই যা হওয়ার এক টেকেই হতে হবে। স্ক্রিপ্ট লেখা হল। আমার চরিত্র খুবই সিম্পলের মধ্যে গর্জিয়াস। নাটকে আমি এমন এক দম্পতির ছেলে যার বাবা এবং মা পরকীয়ায় লিপ্ত। স্কুল থেকে ফেরার পথে আমার প্রথম ডায়লগ “ও মাই গড আব্বু ফিল্ডিং মারতেছে?” এর কিছুক্ষণ পর দ্বিতীয় ডায়লগ “ও মাই গড আম্মুও ফিল্ডিং মারতেছে।” বাস্তবে নাটক রেকর্ড করা খুবই কঠিন হল। এমন রোমান্টিক ডায়লগ আর ফ্লাওয়ারি ভাষা ডেলিভারি দিতে যেয়ে কখনো চরিত্র গুলো হাসি চেপে রাখতে ব্যর্থ হচ্ছে, আবার কখনো পাশ থেকে কেউ ফিক করে হেসে দিচ্ছে। তারমানে আবার রিওয়াইন্ড করে শুরু থেকে করা।
শিশা পার্টি
কেউ একবার কোন গ্রাম থেকে দেখে এসেছিল পাটখড়ির একপাশে আগুন ধরিয়ে অন্যপাশে টানলে সিগারেটের মত হয়। শহরে পাটখড়ি কোথায় পাব? শেষে পত্রিকার নিউজ প্রিন্ট রোল করে টানা শুরু হল। টান দিলেই গলার মধ্যে ছ্যাঁত করে উঠত। খুব একটা বড় মানুষী ভাব হত। কিছু দিনের মধ্যে এই রোলের ভিতর তেজপাতা ঢুকে গেল। আমরা বিরাট এক আবিষ্কার করেছি এমনভাব নিয়ে টানতাম।
ঘর ঘর
গতানুগতিক বাজার করা আর রান্না করার খেলার মাঝে জোর করে কিছু বড়দের বিষয় ঢোকানো হত। যেমন বিয়ে, মুসলমানি, পেটে বাচ্চা নিয়ে ডাক্তারের কাছে চেকআপে যাওয়া। ডাক্তারও খুব মনোযোগ দিয়ে পেটে স্টেথোস্কোপ দিয়ে দেখে বলত মা এবং বাচ্চা দুইজনই সুস্থ আছে। নাটক সিনেমা থেকে শিখে এই খেলায় লেবার পেইন আর ডেলিভারির মত ব্যাপারও যুক্ত হল আস্তে আস্তে। সফল ডেলিভারি শেষে পুতুল হাতে ডাক্তার এসে বলত আপনার মেয়ে হয়েছে। এই খেলায় আমার অংশগ্রহণ থাকলেও খুব একটা মজা পেতাম না। কেমন যেন লাগত। এখন বুঝি এটাকে ক্রিঞ্জ বলে।
ইস্টিং পিস্টিং
ইস্টিং পিস্টিং হল ঘর ঘর খেলার এডাল্ট ভার্সন। এই খেলার একমাত্র সাথী ছিল আমার প্রতিবেশী এবং সহপাঠী। দুজনেই কিন্ডার গার্ডেনে পড়ি। এই খেলায় দক্ষিণী বি গ্রেড মুভির মত কথায় কথায় জড়িয়ে ধরে শুয়ে থাকা আর গালের সাথে গাল ঘষাঘষি থাকত। মেয়েটা লেখাপড়ায় ভাল না থাকলেও তার নেতৃত্ব গুন ছিল। খেলার সব কিছু সেই ঠিক করত, আমি খুশি খুশি মনে সেগুলো পালন করতাম। সেই ঠোটের সাথে ঠোট ছোঁয়ানোয় কোন যৌনতা ছিল না, রোমান্টিকতা ছিল না। শুধু ছিল ছোটদের জন্য নিষিদ্ধ জগতে পা রাখার উত্তেজনা। এই খেলার সমাপ্তি ছিল খুবই মর্মান্তিক। পরস্পরের গোপনাংগ দেখানোর তার প্রস্তাবে রাজি হয়ে গেলাম। প্রথমবার দেখে খুবই অবাক হয়েছিলাম। মনে হয়েছিল, ওরটা এমন বোকা বোকা কেন? কেমন যেন! চ্যাপ্টা। খেলা শেষে মনে হতে লাগল সবাই যেন ব্যাপারটা জেনে গেছে। যাকে দেখি মনে হয় সেই জিজ্ঞেস করবে “কিরে, সিঁড়িঘরে কি করছিলি?” ব্যাপারটা মনের উপর এমন চাপ ফেললো, এরপর তার সাথে আর সিঁড়ি ঘরে যাওয়া হয়নি।
এরপর যখন বড় হয়েছি, ক্রিকেট, ফুটবল কতভাবে কত ফরম্যাটে খেলেছি, কিন্তু কোন খেলাই শৈশবের এই খেলা গুলোর মত বর্নাঢ্য মনে হয়নি। নিজেদের একটা আলাদা জগত ছিল। সেই জগতে আমরা আমাদের জন্য বেধে দেওয়া সীমা অতিক্রম করতাম। সীমা অতিক্রম করার উত্তেজনাই মনে হয় খেলা গুলোকে এত আকর্ষনীয় করে তুলতো।
(চলবে…)
Awaiting for next episode.
Awaiting next episode.