স্তন (প্রথম পর্ব)

১।

“অপারেশন শেষে বাসায় ফিরেছি।ঠিক চারদিন পর আমি আমার ছেলেটাকে কাছে পেলাম। আমার ছেলেটা আমাকে পেয়েই মুখ ভরে হাসি দিলো। কোলে উঠেও তার হাসি থামেনা। একবার এদিক সেদিক তাকায় আর একটু পর পর আমার মুখের দিকে। হাত দিয়ে মুখ ঘুরিয়ে নেয় নিজের দিকে। ঘাড়ে মাথা রাখে। আনন্দে মনে হলো আত্বহারা হয়ে আছে। আমি তাকে পাশে নিয়েই ক্লান্ত শরীরে ঘুমিয়ে পড়লাম। ঘুম যখন ভাঙ্গলো তখন দেখি আমার ৮ মাস বয়সের বাচ্চাটা অনবরত আমার বুকের উপর উঠে মুখ লাগিয়ে রেখেছে। আর কাঁদছে । আমার বাচ্চাটা আমার স্তন খুঁজছে । স্তনে মুখ রেখে মায়ের দুধ খাবার জন্য আকুল হয়ে আছে আমার ক্ষুধার্ত বাচ্চাটা। সেই পর্যন্ত জীবনে আমার সবচেয়ে কষ্টের মুহুর্ত সেটাই। এই যন্ত্রনা ভাষা দিয়ে বোঝানো সম্ভব না । তাকে মাপবে এমন কোন বাটখারা মানুষের পৃথিবীতে নেই।এক মিনিটের জন্য আমার মনে হলো আমার সমস্ত শরীরের বদলে যদি সেই দুটো স্তন আল্লাহ ফিরিয়ে দিতেন তাহলেও আমার কোন আক্ষেপ থাকতোনা। আমি আমার ছেলেটাকে সরিয়ে দিয়ে বেড থেকে নেমে হাউমাউ করে কাঁদতে শুরু করলাম। কান্নার আওয়াজে আমার স্বামীর ঘুম ভেঙে গেলো। বেচারা কয়েকদিন এমনিতেই ঘুমাতে পারেনি। সে কাছে এসে বললো,” কি হয়েছে? “ আমার কান্না যেন তাতে আরেকটু খানি বেড়ে গেলো। সে ব্যাপারটা বুঝে আমাকে জড়িয়ে ধরে বসে থাকলো। ঐদিকে আমাদের বাচ্চাটা বিছানাতে শুয়ে কেঁদেই চলেছে। তার তো জানা নেই তার চেয়েও কত বেশি যন্ত্রনা আমার এই স্তনহীন বুকজুড়ে “

এক নিঃশ্বাসে মেয়েটি তার গল্প শোনালো। তারপর থামলো। আমি তার দিকে একদৃষ্টিতে তাকিয়ে আছি । ৩০/৩২ বছরের তরুনী। স্নিগ্ধ চেহারা কিন্তু তাতে কালো একটা কলুপ পরিয়ে রেখেছে অসুস্থতা-হতাশা-যন্ত্রনা। আমি তার বেদনা অনুভব করার চেষ্টা করলাম কিন্তু বুঝলাম এটা আমার পক্ষে সম্ভব নয়। আমি হাল্কা নিঃশ্বাস ফেলে বললাম, “কষ্ট পেলাম শুনে। খুবই মর্মাহত হবার মতো গল্প। ব্রেস্ট ক্যানসারের সকল গল্পই এমন …“ একটূ ইতস্তত করে বললাম,”আপনি আসলে আমাকেই কেন এসব গল্প বলতে চাচ্ছেন?” সে মুখে হাল্কা হাসি নিয়ে বললো, “ আপনি তো লেখক। আপনার না একটা বই বের হয়েছে? ‘ অনেক রঙের জল’…আমি দেখতে আসলাম, এই রকমের জলের গল্প আপনি জানেন কিনা। “

আমার বাসার ছোট রুমে তখন বাঁকা রোদ ঢুকে পড়েছে। সকাল বাড়ছে, রোদের রঙ গাঢ় হচ্ছে। অফসেট সাদা রঙের রোদ নরম হলুদ হবার জন্য ছুটছে। আমি চা নিয়ে এসে বসেছি।মেয়েটিকেও দিলাম।মেয়েটি চায়ে চুমুক দিলোনা, শুধু একগ্লাস পানি খে্লো। পরিপুর্ণ চোখে আমার দিকে তাকা্লো। তারপর বলতে শুরু করলো, “অল্প সময়ের মাঝেই আমার ছেলেটা আমাকে অপছন্দ করা শুরু করলো বোধহয়। আমার দিকে তাকায়, তীব্র আবেগ নিয়ে কাছে আছে তারপর আমার বুকে কান পেতে দেয়। কি যে সে শুনতে চায়! অল্পক্ষনের ভেতরেই দেখি সে মুখ সরিয়ে নেয়। আমার দিকে অভিমানী চোখে তাকিয়ে থাকে। তারপর মুখ ঘুরিয়ে রাখে। আমাকে অবহেলা করে, ঘৃনাও হয়তো কিছুটা করে। মানুষের স্বার্থপরতা সম্ভবত তার স্বভাবজাত বৈশিষ্ট্য। এইযে ছোট শিশু সেও দেখেন কেমন করে দুধের অভাবে মাকে এড়িয়ে যাওয়া জানলো! “

আমি হাল্কা গলায় বললাম, “ কি বলছেন এগুলো! বাচ্চা ছেলে আট মাস বয়স মাত্র! “।মেয়েটি মৃদু হেসে বলে্, “ হুম, আট মাস বয়সের বাচ্চা বটে, তার মাঝে এতো ভুল খোঁজার কোন মানেই নেই কিন্তু যার বয়স পয়ত্রিশ হয়ে গিয়েছিলো? তাকে কি বলবেন? যার সাথে সাত বছর ধরে সংসার করছিলাম?

গল্পের এই অংশটুকু শুনতে হবে বা এমন একটা পরিস্থিতি আসবে এমন ভেবে আমি আগে থেকেই বিচলিত ছিলাম। যখন সেটার আগমন ঘটেই গেলো আমি তাকে থামাতে পারলামনা। সে বলেই যাচ্ছিলো, “আমার স্বামী প্রায় দুই সপ্তাহ পর আমার খুব ঘনিষ্ঠ হলো। অপারেশনের পর দুর্বল শরীর , মানসিক যন্ত্রনা সব মিলিয়ে একাকার ছিলাম। তবুও সে যখন আমার কাছে এলো, আমার কেন যেন খুব ভালো লাগছিলো। অনেকটা দিন মানুষটিকে বঞ্চিত রাখার কারনে কিছু অপরাধবোধ ছিলো। যদিও এই অপরাধ আমার নয় তবুও সমাজ আমাদের এমন মনে করিয়ে দেয় যে কোন কারনে যদি আমরা স্বামীকে খুশি রাখতে না পারি তো সেটা আমাদেরই বিরাট অপরাধ। তিনি আমার কাছে জড়িয়ে গেলেন। অসংখ্য লাল নীল চুম্বনে ভরে গেলো আমার কোমলতাহীন শুকনো ঠোট, মুখ , কপাল। দীর্ঘদিন পর আমার মৃত প্রাণ যেন জ্বলে উঠলো। এইযে, এতো বড় অপারেশন, মানসিক – শারিরীক দুর্বলতা আর পরাজয়ের গ্লানি তার মাঝেও শরীর তো ফুরিয়ে যায়না! আমার শরীর একটু একটু করে তার ভিতরের আদিম লালসাকে জাগিয়ে তুলছে। কিন্তু সে আর কতটা!! আমার স্বামী হঠাৎ করেই থেমে গেলো। ঝড়ের আভাস দিয়ে যে পাগলাটে বাতাস এসেছিলো হৃদয়ে তার গতি আর অস্থিরতা কমে গেলো। কোথায় যেন আমার স্বামী আটকে গেলো, দমে গেল্‌, থেমে গেলো। তার প্রাণ কোন এক অশ্বত্থ গাছের তলায় চলনহীণ নষ্ট সাইকেলের মতো থেমে যাইতে চাইলো।সে আমাকে ছড়িয়ে দিলো। বাসার কার্নিশে দাঁড়িয়ে সিগারেট টানলো দীর্ঘক্ষন।“

সিগারাটের প্রসঙ্গ ওঠাতেই কিনা জানিনা আমার মনে হলো আমার সিগারেট খাবার খুব দরকার অথচ তিন মাস হলো আমি সিগারেট খাইনা। একদমই না। এই তিন মাসের মাঝে আর কোনদিনই এমন তৃষ্ণা লাগেনি।

মেয়েটি বলে চললো” নারীদের স্তনের উপরে পুরুষ মানুষের অনেক বড় নির্ভরতা , জানেনতো? জীবনের শুরুতে তার মায়ের বুকের দুধ লাগে আবার যৌবনের শুরুতে তার সকল ফ্যান্টাসি মেটাতে হয় সেদিকে চেয়েই। ছোট্ট দুইটি মাংসের টুকরো দিয়ে জীবন বাঁচাতে প্রয়োজন হয় একটা শিশুর আবার যুবকের সমস্ত লালসা সুখ সব ক্রমে এসে জমে সেই মাংস পিন্ডেই।দুটো উচ্চ স্তনের আভাস পেয়ে কত পুরুষ নারীর দাস হয়ে যায় আবার প্রয়োজন ফু্রিয়ে গেলে তার আর কোন আদর থাকেনা, সে তখন বাজারে বিক্রি হওয়া মরা গরুর মাংসের চেয়েও কম দামী। সকল আনন্দ মেটাতে গিয়ে মাংসের পিন্ডগুলোকে ছিন্ন বিচ্ছিন্ন করে ফেলতে ফেলতে কয়জন পুরুষের মনে পড়ে অন্য কোন নারীর স্তনেই তার জীবন বেঁচেছিলো ?আবার সেই পুরুষই যখন বাবা হয়ে যায়, তখন বাবা-সন্তান একসাথে প্রয়োজন মেটায় সেই এক স্তনেই! বড় আহলাদের সময় তখন । নারীরা বোঝে তার কাছে ফিরে ফিরে আসে দুই জনেই। প্রথম জন জীবন বাঁচায়, দ্বিতীয়জন আনন্দ মেটায়। তাতে কারোরই দোষ থাকেনা, মানুষতো এভাবেই বড় হয়েছে চিরদিন! “

এবার আমার একটু বিরক্তি লাগলো, কোন কারন ছাড়াই। শব্দগুলো ঝাঁঝাঁ করে কানের উপরে ক্রমাগত আঘাত করে যাচ্ছিলো। আমি জানালার কাছে গিয়ে দাড়ালাম। ঝকঝকে রোদের আকাশ দেখে মনে হচ্ছে সে তার সিদ্ধান্ত বদলে নিয়েছে। এক কোনায় কালো মেঘের মতো স্তুপ জমা হতে শুরু করেছে। অনেকক্ষন চুপ থেকে আমারই মনে হলো কিছু বলা দরকার। আমি বললাম, “ তারপর? “
-আমার স্বামী একটা কাজ করলো এরপর। মায়ের বুকের দুধ কতটা দরকারী একটা বাচ্চার জন্য সেই সব নিয়ে দুনিয়ার তথ্য জোগাড় করতো। আমাকে শোনাতো। আর হঠাৎ একদিন দেখলাম শ্যামলা করে মিষ্টি চেহারার একটা মেয়ে এসে উপস্থিত আমার বাসায়। আমার স্বামীর খালাতো বোন। বাচ্চা মরে গেছে জন্মের পরপরই। স্বামীও দেশে থাকেনা। আমার ছেলেটাকে সে নিয়ে গেলো। সে হয়ে গেলো তার দুধ মা। আমার চোখের সামনেই দেখলাম আমার বাচ্চাটা তার বুকে পরে থাকতো! যেন সে মনে করেই নিয়েছে এই তার মা। আমি কেউ না? কেউই না? মাঝে মাঝে নিজেকে খুব হীন মনে হতো। মনে হতো আমি সইতে পারছিনা কেন? আবার মাঝে মাঝে মনে হতো এইতো আর কিছুদিন মাত্র। আমার ছেলে আমার কাছেই আসবে। রাতে মাঝে মাঝে যখন সে কেঁদে উঠতো আর আমার স্বামী বলতো, “বেলীকে ডাকো, দুধ খাওয়াক।“ আমি শক্ত করে আমার বাবুকে জড়িয়ে ধরতাম , বলতাম, “ফিডার দাও। কোথাও যেতে হবেনা বাবুর” কিন্তু আমার ছেলেতো ফিডার সরিয়ে দিতো এবং আমাকেও। বেলি এসে কোলে করে নিয়ে যেতো , তারপর সারারাত আর সে আমার বুকে ফিরতোনা। আমার বুক খালি হয়ে থাকতো সমস্ত রাত। মানুষ শুধু আমার উপরের শুন্যতাই দেখতো, বুকের ভিতরে যে কি বিশাল শুন্যতা একেকদিন তৈরী হতো সে খবর কে রাখতো?”

খুব একটা মায়া লেগে গেলো আমার। একটা মানুষ শারীরিক আর মানসিক ভাবে এতোটা ধকল পেতে পারে একই সময়ে!! একবার তার দিকে তাকিয়ে চোখ সরিয়ে নিলাম। তার চোখের চোখ রাখার মতো সাহস হলোনা। কিন্তু এরপরেই মনে হলো আজকের সবচেয়ে নিষ্ঠুর কথাটা শুনলাম।

“বেলি আমার ছেলের চাহিদা মিটিয়ে যাচ্ছিলো। আর এক রাতে আমি তার রুমে উঁকি দিয়ে দেখলাম সে আমার স্বামীর চাহিদাও সে মেটাতে শিখেছে। আমার স্বামীর তার বুকে আবিষ্ট হয়ে শুয়ে আছে। কি অদ্ভত না বলেন? তারা তিনজনেই তিনজনের শুন্যতা পুরন করে যাচ্ছে আর মাঝখান থেকে শুধু আমিই এক বুক শুন্যতা নিয়ে পড়ে আছি। মনে হলো তিনজনের এই সংসারে আমি বাইরের কেউ। আমি তাদের কেউই না।“

ছোট মেঘগুলো হঠাৎ করেই বেশ বড় হয়ে গেছে। কালো রঙ করেছে। আমার অবশ্য কালো মেঘ নয় বরং মনে হলো যেন আঁধার নেমেছে, আরো নীচে নামতে নামতে সেগুলো এক হয়ে জমা হয়েছে এই তরুনীর মুখে। একজন মানুষের মুখে এতো আঁধার আমি আর কবে দেখেছি মনে করতে পারিনা !!

সেই মুখ ভর্তি আঁধারের কোল থেকেই বৃষ্টির জলের মতো জল গড়িয়ে পড়লো। মেয়েটা কেঁদে উঠলো, “এতোগুলো দিন চলে গেছে জানেন? আমার ছেলে আর আমাকে মা ভাবেনা। সে তার মায়ের নাম ভুল জানে। এই যন্ত্রনা নিয়ে আমি কোথায় থাকি বলেন?”
আমি বললাম, “ মানে কি? আপনি আপনার ছেলেকে নিয়ে থাকবেন? নিজের হাতে কোলে নেবেন। মা তো আপনিই। আপনার স্বামীর সাথে ঝগড়া করবেন! “
সে গাঢ় বিষন্ন কন্ঠে বললেন, “সেই ক্ষমতা যে আমার আর নেই। দুঃখ পাওয়া বাদে আমার আর কোন ক্ষমতাই নেই।আমি বিস্ময় নিয়ে তাকিয়ে রইলাম। এই কথাগুলো আমার ভিন্ন লাগছে। তার স্বামীকে বেলীকে বিয়ে করেছে? তাকে বের করে দিয়েছে? সেইসব জিজ্ঞেস করতেও কষ্ট লাগে, হীন লাগে নিজেকে, সংকোচ লাগে।
সে বললো, “আমি আপনার বই পড়িনি কিন্তু আপনার বন্ধু নিয়ে এসেছিলো বইটি।আপনার অনেক গল্প করতো। আমিতো তার আর কোন বন্ধুকে চিনিনা। তাই আপনার কাছে এসেছি। আপনার বন্ধুর নাম “হাবীব”। পাবনাতে আপনারা স্কুল বন্ধু ছিলেন। আপনারা নাকি একসাথে স্কুলে থাকতেই পত্রিকা বের করতেন। “প্রান্তর”। তার একটা কপি বাসায় ছিলো। সে যত্ন করে রেখেছে। …একদিন আসবেন তার কাছে । আপনার বন্ধুকে কিছু বলবেন। বলবেন, সে যেন বাবুকে আমার কথা বলে… আর যা ইচ্ছা সে করুক। আমাকে ভুলে যাক। যা ইচ্ছা করুক। শুধু আমার ছেলেটা যেন মায়ের না্ম বলতে আমার নামই জানে… আপনাকে আমি ভাই ডাকলাম…দেখুন প্লিজ. ভাই…”

আমি তার দিকে তাকিয়ে দেখলাম দুইচোখ দিয়ে ঝর্নার মতো করে পানি ঝরছে। আহারে! আহারে!!বাইরেও বৃষ্টি নেমেছে। বৃষ্টি গাঢ় ভাবে নামার আগেই আমি জানালা আটকিয়ে দিতে উঠলাম। সবগুলো ঘরের সবগুলো জানালা আটকে দিয়ে এসে দেখি মেয়েটা নেই। এই বৃষ্টি বাদলার দিনে সে কোথায় গেলো! বেশ খারাপ লাগলো। একটাও স্বান্তনার কথা বলা হলোনা।নামটাও জানা হলোনা। শুধু একটা কথায় মনে রইলো, আমার স্কুল বন্ধু হাবীবের স্ত্রী। হাবীবের বাসায় গিয়ে কি আর হবে। তবে মেয়েটা এতোবার বলেছে, আমি যাবো। পৃথিবীর সবচেয়ে অন্ধকার মুখটার অনুরোধে আমি অবশ্যই সাড়া দেবো।

২/

রাজশাহী শহরের মাঝামাঝি জায়গায় বাসাটা। ১৩ তলা বাসা। লিফটে ৬ তলা উঠেই বা্ম দিকের ফ্ল্যাট। কলিং বেল টিপতেই শ্যামলা করে একজন তরুণী বের হয়ে আসলো।আমি বললাম, “আমার নাম সৈনিক। আমি হাবীবের স্কুল ফ্রেন্ড “ তিনি হাসি মুখে বললেন, “আসেন ভাই। আপনার কথা আমি জানি। আমি হাবীবের স্ত্রী।আমার নাম রিয়া।“ আমি একটু বোকা বনে গেলাম। এই মেয়ে তার স্ত্রী মানে কি? নাম বেলি হলে অন্তত কিছু বোঝা যেতো? রিয়া কেন? কোথাও একটা বড় রকমের অসামাঞ্জস্যতা। তিনি পথ ছেড়ে দিলেন। আমি ভিতরে ঢুকলাম।
বাসার ভেতরটা অনেকটাই এলোমেলো। আমাকে ড্রয়িং রুমে বসতে দেওয়া হলো।একটা বেশ পুরাতন রকমের সোফায় বসে আছি আমি। একপাশের দেওয়ালে দেখলাম হাবীব, তার স্ত্রী আর বাচ্চাটার ছবি। বাচ্চার বয়স মনে হচ্ছে তিন-চার হবে। আমি উঠে দাঁড়িয়ে সেই ছবিটার দিকে তাকিয়ে রইলাম। একটা বাচ্চার কন্ঠ শুনতে পেলাম।
-তুমি কে ? এই তুমি কে?” ঘুরে তাকিয়ে দেখি ছোট একটা বাচ্চা। কোঁকড়ানো চুলে মাথা ভরে আছে।স্বাস্থ্য উজ্জ্বলতায় ভরে আছে। বিস্ময় ভরা চোখ নিয়ে সে আমার দিকে তাকিয়ে আছে। আমি কাছে গিয়ে হাটু গেঁড়ে বসে জানতে চাইলাম , “ তোমার নাম কি? “
-আলিফ, আমার নাম আলিফ। বাবা হাবীবুর রহমান। মা আয়েশা আক্তার রিয়া। দেশের বাড়ি…” আমি হেসে উঠলাম।
-বাপরে বাপ । নাম জিজ্ঞেস করলে পুরো পরিচয় দিতে হয়?
-তুমি বাবার কেমন বন্ধু?
-ছোটবেলার বন্ধ। আমি আর তোমার বাবা একই স্কুলে পড়তাম।
হাবীবের স্ত্রী ততক্ষনে রুমে ঢুকে গেছেন। আমার দিকে তাকিয়ে বললেন,
-তারপর তো আর কেউ কারো তেমন খোঁজ রাখেননি। স্কুল জীবনে এতো গাঢ় সম্পর্ক ছিলো তবু…
আমি হেসে বললাম, আসলে আমিও পাবনা ছেড়ে গেলাম আর ঐদিকে আরো বন্ধু বান্ধব নিয়ে ব্যস্ত হয়ে গেলাম।
-আপনি কিন্তু হাবীবের মন থেকে চলে যাননি… আপনারা স্কুলে থাকলে যে “প্রান্তর” নামে পত্রিকা বের করতেন তার কপিও সে যত্ন করে রেখেছে। আপনার তিনটা বইই সে কিনেছে। প্রায় মন খারাপ করে বলে, সৈনিকের বইগুলো যে কেন হিট হয়না?
বিব্রত হচ্ছিলাম। সেদিক থেকে কথা ঘুরিয়ে নিতে ইচ্ছে হলো। বললাম,
-আপনার বাবুর বয়স কত?
-এই চারে পড়েছে গত মাসে।
-হাবীব কতদুর? তাকে জানিয়েছেন যে আমি এসেছি?
-হুম। সে পথে …আপনি চা খান।

আমি কাপ হাতে নিলাম। গাঢ় ঘিয়ের মতো রঙ হয়েছে দুধ চায়ের।আমি একটু মেলাতে চাইছিলাম ।লিটল ম্যাগাজিন “প্রান্তর”র কথাতো সেই মেয়েটিও বলেছিলো। রিয়াও বলছেন। মিলে যাচ্ছে। তাহলে আসলে কে সত্য? মেয়েটি বলেছিলো, তার বাচ্চার বয়স ছিলো আট মাস।ধরলাম তারপর এদিক সেদিক মিলিয়ে এক বছর বা দুইবছর হয়ে থাকতে পারে।এখন ছেলেটাকে দেখলাম, জানলাম চার বছর পার হয়ে গেছে। কেমনে কি বুঝতে পারছিনা।একগাদা অস্বস্তি নিয়ে বসে রইলাম। একটু পরে হাবীব এসে ঢুকলো। আমাকে দেখে জড়িয়ে ধরলো।

-কিরে! কোনদিন তো ভাবিনি তোর সাথে দেখা হবে। ইনফ্যাক্ট কোন বন্ধু বান্ধবের সাথেই তো গত চার/পাঁচ বছর ধরে যোগাযোগ নেই।
– আমি আসলে দুই সপ্তাহ ধরে খোঁজ নিয়ে ঠিকানা পেলাম। শুধু আজিজ বলেছিলো যে তুই সোনালী ব্যাংকে চাকরি করিস। তারপর খোঁজ নিতে নিতে এখানে… পুরোনো বন্ধুদের সাথে দেখা হওয়া দরকার, তাই খুঁজছিলাম ।
-খুব ভালো করেছিস। লাঞ্চ করে নেই চল। আমি আর আজ অফিস যাবোনা। গল্প করে সময় কাটিয়ে দেবো।

রিয়া ভাবীর হাতে আসলেও যাদু আছে। দারুন সব রান্না খেলাম। গল্প করছিলাম। আমাদের শৈশবের গল্প। বেড়ে ওঠার গল্প। দুষ্টুমির গল্প। বিয়ের গল্পও আমিই শুরু করলাম। তারপর শেষ করে হাবীবকে জিজ্ঞেস করলাম, তোর বিয়ের গল্প বল? সে একটু হতাশার মতো করে বললো, আমাদের বিয়ে হঠাৎ করেই হলো। ইনফ্যাক্ট তেমন কোন আয়োজনও ছিলোনা। আসলে একই গ্রামের মেয়ে। পছন্দ আগে থেকেই ছিলো । দুইজনের। হাহাহাহা।

এইরকম গল্পের সময়ে আর কোন প্রশ্ন আনা মুশকিল। তবুও প্রবল আগ্রহ থেকে আমি জিজ্ঞেস করলাম, তুই কি আগে কোন বিয়ে করেছিলি?
-কি বলিস? একটাই জীবন একটাই বিয়ে। শালা আমি কি ফাউল নাকি? হাহাহাহা…
করবোনা করবোনা করেও মুখ ফেটে বের হয়ে গেলো অদ্ভুত প্রশ্নটা
-বাসায় কারো ব্রেস্ট ক্যানসার হয়েছিলো…মানে ভাবির কি ব্রেস্ট ক্যানসার হয়েছিলো কখনো?
হাবীব বেশ অবাক হয়ে বললো, “ আরে কি যন্ত্রনা। জলজ্যান্ত মানুষ। তুই আমার বউরে কি বানাচ্ছিস? আচ্ছা বলতো এসব কোথা থেকে পাস খবর? আজিব! পাগল হয়ে গেছিস !”

আমিও তাই ভাবছিলাম। পাগল হয়েই গেছি বোধ হয়। একটা রোদ-বৃষ্টি সমান্তরাল প্রবাহের দিনে কে এসে কি বলে গেলো তাতেই…তাছাড়া ইনফরমেশনেও অনেক গ্যাপ। কিভাবে এসব এক হয়।কিন্তু আমি চোখ বন্ধ করলে এখনো সেই মেয়েটির আধার ভরা মুখ দেখতে পাই। ঝর্নার মতো নেমে আসা চোখের জল দেখতে পাই।তাকে মিথ্যে ভাবতে ইচ্ছে হয়না!

আমি বিদায় নিয়ে বের হলাম সন্ধ্যার দিকে। নীচের দারোয়ানকে বললাম, হাবীবরা কতদিন এই বাসায়? দারোয়ান সাহেব বললেন, তিন বছর হলো। সেই তিন সংখ্যাটা আমার মাঝে প্রবল দ্বিধা তৈরী করলো। আমি চোখ বন্ধ করে আবার সেই দুঃখী মুখটি দেখতে পাইলাম। আধার মুখটি করুন কন্ঠে বলে ওঠে, ভাই। আমি আপনাকে ভাই ডেকেছি।

আমি দুই হাত মুঠো করে বিরবির করে বললাম, আমি এভাবে শেষ হতে দেবোনা গল্পটি। এভাবে শেষ হবেনা তার গল্প। আমি শেষ দেখে নেবো।অবশ্যই দেখে নেবো!

(প্রথম পর্ব শেষ)

দ্বিতীয় পর্বঃ জননী (স্তনঃ ২)

আমার অন্য লেখা পড়ুন

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here

Reviews

Popular Articles