ফোর স্কয়ার মিটার

SabbiRif

১.
ঢাকার রাস্তাগুলো রাতে সুন্দর! রাত দুইটার পর! কোন জ্যাম নেই, একটানে সাঁই করে ছুটে চলে যাওয়া যায় বাসায়। সাজিদ লেফট টার্ন নেয়, একটু সামনেই মহাখালী ফ্লাইওভার। একটু একটু ঠান্ডা পড়ে গেছে, ফ্লাইওভারের এক পাশে গাড়ী থামিয়ে কিছুক্ষণ বাতাস খেতে পারলে খারাপ হয় না! রাতে ধূলা একটু কম থাকে, তবে যে দিনকাল পড়েছে ছিনতাইকারীর কবলে পড়ার সম্ভবনা বেশী।

সাজিদের বয়স বত্রিশ! একটা কল সেন্টারের সিইও সে। বেশীরভাগ দিন রাতের বেলায় কাজ থাকে। বাসায় বাবা-মা আর দুই বোন। বাবা রিটায়ার্ড আর্মি অফিসার, প্রচন্ড কড়া স্বভাবের মানুষ। বাবার কথা, এক বোনের বিয়ে না হওয়া পর্যন্ত সে যেন বিয়ে না করে; এজন্যেই এখনও বিয়ে করা হয়ে ওঠেনি। প্রেম করার যে চেষ্টা করেনি তা না, কেউ পাত্তা দেয় নাই! এক মেয়ে বলে বসেছে, পাগল না কি??

গাড়ীটা উপরের দিকে ওঠার সময় একটু স্পিড বাড়িয়ে দিতে হয়, না হলে তার ভয় হয় গাড়ীটা উল্টোদিকে গড়ানো শুরু করবে! গড়াতে গড়াতে এটা চলে যাবে গোল্লায়, ঠিক ঐ গানটার মতো, “গোল্লায় নিয়ে যাচ্ছে আমায় হাওয়ায় জ্বলের গাড়ী”! ঢাকা শহরের রাস্তায় কোথাও কি স্পিড লিমিট লেখা আছে? নেই মনে হয়, এতদিন গাড়ী চালানোর পরও খেয়াল করা হয়নি কখনও! খেয়াল করেই বা কি লাভ? কিছুদূর সামনে একটা আবছা ছায়া-মূর্তি দেখতে পায় সে, হাত দেখিয়ে গাড়ী থামাতে বলছে। সাজিদ ভেবে পায় না গাড়ী থামাবে কি না, ছিনতাইকারী নয় তো! আরেকটু কাছে যেতেই ছায়ামূর্তিটা স্পষ্ট হয়ে ওঠে। একটা মেয়ে, বিয়ের শাড়ী পরা, পাঁচ ফুট ছয়ের কাছাকাছি লম্বা হবে। বিপদে পড়ে নি তো! না কি কল-গার্ল টাইপের কিছু? আচ্ছা কল-গার্ল কি সেরকম কেউ যে কলের তলায় দাঁড়ায় থাকে? কি সব আবোল-তাবোল!

সাজিদ গাড়ী থামাবে কি থামাবে না চিন্তা করতে করতে ব্রেকে মনের অজান্তে পা চলে যায়। মেয়েটা কাছে আসে। সাজিদ তার দৃষ্টি ফেরাতে পারে না মেয়েটার চোখ থেকে। ভরপুর কাজল দেওয়া একটা চোখ, চোখ থেকে যেন গান ভেসে আসছে, “আমি ফ্লাইওভারের রাজকন্যা ফ্লাই করে এসেছি, নাবিস্কো পার হয়ে আমি তোমার কাছে এসেছি”! বাই দ্যা ফ্লাইওভার, নাবিস্কো বিস্কিট কি এখন বাংলাদেশে পাওয়া যায়? 
– কেমন আছেন?
– জ্বি ভালো, আপনি কি কোন সমস্যায় পড়েছেন?
– সমস্যা তো সবসময় থাকে। সবার থাকে, একটা মানুষ দেখান তো সমস্যা ছাড়া! নাকি আপনি পাগল যে আপনার সমস্যা নেই?

সাজিদ একটু থতমত খায়, আসলেই কি সে পাগল, এই নিয়ে দুইটা মেয়ে বললো! তার কি পাবনায় ভর্তি হওয়া উচিত? নিজে নিজে ভর্তি হতে গেলে দেখা যাবে পাগল বলে তাড়িয়ে দিতে পারে! পাগলের হাসপাতালে গেল আর সেখান থেকে কেউ পাগল বলে তাড়িয়ে দিল, কি একটা বেইজ্জতির ব্যপার! 
– গাড়ি থামালেন যে? কিছু দরকার?
– গাড়ী তো আপনি থামালেন, আমি তো হাত দেখালাম মাত্র!

মেয়েটা খিল-খিল করে হেসে ওঠে! সাজিদ হঠাৎ ভয় পায়, নিশ্চয় কোন ছিন্তাইকারীর খপ্পরে পড়তে যাচ্ছে আজ! অথবা মলম পার্টি, সিনটা এরকম – তার চোখে মলম, সে বাঁচাও বাঁচাও বলে চেঁচাচ্ছে! একটু পরে সে মারা যাবে, তখন তার কাছে তিনটা প্রশ্ন করা হবে! তিনটা প্রশ্নের উত্তর সে মনে প্রাণে মনে করার চেষ্টা করে, শালার কাজের সময় কিছুই মনে পড়ে না! জাহিদ হাসানের মতো ফেরেস্তা বললো, ‘তুমি ফেইল’! নাকি রাগের চোটে তুই করে বলবে? আচ্ছা আরবিতে ইংলিশের মতো তুমি, তুই সবই কি “ইউ” টাইপ? 
– কিছু বলবেন?
– আসলে আমি মারা যাচ্ছি, মারা যাচ্ছি বললে ঠিক ভুল হবে, মরে যেতে চাচ্ছি। একটু পর আমি ফ্লাইওভার থেকে লাফ দিবো। মনের মধ্যে অনেক কথা জমে আছে, এত কথা মনের মধ্যে রেখে আসলে মরে যাওয়াটা ঠিক হবে বলে মনে হয় না! তা না হলে দেখা যাবে কথার ভারে আত্মা ঠিকমত উড়তে পারছে না! একসময় দেখা গেল আপনার বেল্কনিতে দাঁড়িয়ে আছে, সেই আত্মা আপনি আবার দেখতে পাচ্ছেন! আপনার বিপি বেড়ে একাকার! ডাক্তার আপনাকে মৃত ঘোষণা করেছে, এরপর আমরা এক সাথে অন্য আরেকজনের বারান্দায়, সেও আমাদের দেখতে পাচ্ছে!
-আচ্ছা আপনার বারান্দার সাইজ কি?
-জানি না
-আচ্ছা বলেন তো, ফোর স্কয়ার মিটারের বারান্দায় কতগুলো আত্মা দাঁড়াতে পারবে?

এই বলে মেয়েটা আবার খিল-খিল করে হাসতে থাকে। সাজিদের কি আতংকিত হবে? মেয়েটার চোখ থেকে চোখ নামানো কঠিন হয়ে যাচ্ছে, একটা মেয়ে কিভাবে এত সুন্দর করে হাসতে পারে! সে কি অনেক হাসের ডিম খায়, বেশী বেশী হাসের ডিম খেলে সে যে ডিন্ট্যান্সে দাঁড়ানো তাতে করে তার মুখ থেকে গন্ধ আসার কথা, সেটা আসছে না! বরং একটা পারফিউমের গন্ধ পাচ্ছে সে!

পারফিউমের প্রতি সাজিদের একটা দুর্বলতা আছে, জিজ্ঞেস করে দেখবে না কি এটা ভার্সাচে না কি গুচি? 

– আপনি ভয় পাচ্ছেন, তাই না? কি মনে হচ্ছে ছিনতাইকারী বা ওই টাইপের কিছু? হা, হা! আচ্ছা মনে মনে এটা ভাবছেন না তো কল-গার্ল কি কলের তলায় দাঁড়ায়ে থাকে? আসলে কি হয়েছে জানেন, গত বছর এই দিন আমার বিয়ে হওয়ার কথা ছিল, আমার বয়ফ্রেন্ডের সাথে। বিকেলে তিতুমীর কলেজ হয়ে গুলশান-১ যাচ্ছিল শেরওয়ানী আনতে। হঠাৎ মারামারি শুরু হয়, কারো তেমন কিছু হয়নি জানেন, শুধু একজন মারা গেল। 
– আই এম স্যরি।
– স্যরি হওয়ার কিছু নেই। পেপারে প্রায় আসে না, “ও মারা গেছে, সে মারা গেছে”
– এতে কি কারো কিছু যায় আসে? আসে না। যার আপনজন চলে যায় তার ছাড়া। অনেক কথা হলো, এখন লাফ দিই, কি বলেন? আচ্ছা, একটা কথা এখান থেকে দিলে না মরার প্রবাবিলিটি কত? আপনি সায়েন্স এর ছাত্র কি? এক কাজ করা যাক, আজকে লাফ না দিই, কাল সকালে আপনি এসে ফিতা দিয়ে মেপে দেখবেন হাইট, তারপর g সহ হিসাব করে বলবেন, প্রবাবিলিটি কত? স্মল লেটারের g কিন্তু, ক্যাপিটাল না! এরপর ভাববো এখান থেকে লাফ দেওয়া ঠিক হবে কি না! মেয়েটা আবার খিল-খিল করে হেসে ওঠে! 

সাজিদ চিন্তা করে আচ্ছা মেয়েটা সত্যি সত্যি ঝাঁপ দিবে না তো। শুধু এই হাসি দেখে সে সারাটা জীবন পার করে দিতে পারবে, এই কথাটা কি সে বলতে পারবে না! পেছন থেকে একটা গাড়ী আসার আওয়াজ পাওয়া যাচ্ছে।  সাজিদ ব্যাক মিররে পুলিশের গাড়ী দেখতে পায়। এখন সে কি করবে বুঝে উঠতে পারছে না। আজ ঘুম ভাঙার পর কার মুখ দেখেছিল কে জানে! নিজেরই হবে, আয়নাতে! 
– আপনি উঠে আসুন, না হলে পুলিশ দু’জনকে হাজতে পুরবে। তখন আর সুইসাইড করা হবে না।
মেয়েটি সাজিদের কথায় পাত্তা দেয় না, উল্টো দিক ঘুরে গুন গুন করে গান গাইতে থাকে। গানটা পছন্দের সাজিদের,
“কিচ্ছু চাইনি আমি আজীবন ভালোবাসা ছাড়া, আমিও তাদের দলে বার বার হেরে যায় যারা”! সাজিদ গাড়ীর হ্যাজার্ড লাইট অন করে দেয়।

২.
পরদিন রাতে সাজিদ পাঞ্জাবী পরে তার রুমের সামনে দাঁড়ানো, ঢুকবে কি না বুঝতে পারছে না! আজ সারাদিন যে ধকল গিয়েছে! হায় হায়, অফিস থেকেও তো ছুটি নেওয়া হয় নি! সারাদিন যা ঘটেছে, তা চিন্তা করে এক প্রকার অস্বস্তি লাগছে তার। সকালে বাবা থানায় গিয়ে তাদের দু’জনকে ছাড়ায় আনছে। মেয়ের বাসায় ফোন দিয়ে তাদেরকে আসতে বলছে, মেয়ে নাকি বাসায় বলছিল বান্ধবীর বোনের বিয়েতে যাচ্ছে, সকালে ব্যাক করবে। সাজিদ কি জানি একটা বলতে গিয়ে জোরে একটা থাপ্পড় খেল বাবার কাছে, একটা দাঁত হাল্কা হাল্কা নড়তেছে মনে হয়! এরপর তাদের বিয়েও হয়ে গেল।

অদ্ভুত, মেয়েটা কিছুই বললো না! সারাদিনে সে দুটো কথা বলেছে। একটা তার বাসার ঠিকানা এবং দ্বিতীয়টা কবুল। বাবা নিশ্চয় ভেবে বসে আছে, পালিয়ে বিয়ে করার জন্যে এত নাটক, পরে স্বাক্ষী ম্যানেজ হয় নাই। 
কাবিনে মেয়েটির নাম কি লেখা ছিল খেয়াল করা হয় নি! সাজিদ যে রুমে যাবে সে সাহসও পাচ্ছে না! কি বলবে মেয়েটাকে? এতটুকু সাহসী তাকে আজ হতেই হবে। মেয়েটা বেল্কনিতে দাঁড়িয়ে, তাকে দেখা মাত্রই খিল-খিল করে হেঁসে ওঠে। এই হাসি দেখেই সে এক জীবন পার করে দিতে পারবে, নাম না জানলেও খুব একটা ক্ষতি নেই।।  নীরবতা ভেঙে মেয়েটা কথা বলে, হায় হায় সত্যি সত্যি আপনার বেল্কনি তো ফোর স্কয়ার মিটার! আপনার দেখি আবার বিপি বেড়ে যাচ্ছে! 

৩.
সাজিদ আজকে ফ্ল্যাইওভার এভোয়েড করবে! তার পাশে বসে মেয়েটা হাসছে, অবভিয়্যাসলি খিল-খিল করে! তার দিকে তাকাতেই জিজ্ঞেস করলো ফ্ল্যাইওভার দিয়ে গেলেন না যে আজ? কি? ভয় পেয়েছেন?? সাজিদ সব কিছু ঝাপসা দেখছে এখন! 

কোথা থেকে আবার জানি একটা ব্যাকগ্রাউন্ড মিউজিক ভেসে আসছে, “তুমি ফেইল, তুমি ফেইল”!!

SabbiRif এর সবগুলি গল্প পড়ুন এখানেঃ সাব্বিরিফ

1 COMMENT

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here

Reviews

Popular Articles