বনের বাঘ ও মনের বাঘের গল্প

সাজিদ রহমান

বাঘ নিয়ে বাজারে অনেক গল্প আছে। সে গল্প বাজারে থাকলেও সেটা মোটেও বাজারি নয়। আমার গল্পটাও সেরকম কোন এক বাঘ নিয়ে। আর আমার বাঘটি কিছুটা বনের, আর বাকিটা মনের। সেই বাঘের গল্পে ঢুকতে হলে কিছুটা পিছনের দিকে ফিরতে হবে।

অনেক অনেক আগের কথা। সন্ধা হলেই মাস্টার নানীর বাড়িতে কিংবা কলোনীতে রাসেলদের বাসায় টিভি দেখতে যেতাম। পথেই পড়তো ঝাকড়া একটা বটগাছ। রাত হলে সেটাই ভূতের মত দাড়িয়ে থাকত। ভয় দেখানোর জন্য সে একাই যথেষ্ট ছিলো। তার উপর গাছের ঠিক নিচে ছিলো দুইটা পুরাতন কবর। এই দুইয়ে মিলে ভয় দেখানোর মনি-কান্চন যোগ হয়েছিলো বলা যায়। শুধু মহররমের সময় হলে পাড়ার কয়েকটি বিহারি পরিবার সেই কবরে মোমবাতি জ্বালিয়ে দিত। ঐ রাতটা ছিলো স্পেশাল, ভয়ের ভূতরা অন্য কোথাও বেড়াতে যেত। কিন্তু বছরের বাকী ৩৬৪ দিন নিয়ে একটা কথাই বলা যেত, হরিবল হরিবল। কারন একটু অন্ধকার হলেই সেই কবর হয়ে উঠত সাক্ষাৎ জমের মত। বাংলা সিনেমার গানের অনুষ্ঠান ছায়াছন্দ এবং সাপ্তাহিক নাটক ছিল পছন্দের তালিকায় সবার উপরে। বিশেষ করে শীতের রাতে কুয়াশার চাদরে ঢাকা পরিবেশে টিভি দেখে ফেরার সময় মনে হত, এই বুঝি কেউ কবর হতে বের হয়ে ঘাড় মটকে দিবে। সেই ভয় থেকে রক্ষা পেতে চোখ বুজে ভো-দৌড়ই ছিল একমাত্র ভরসার নাম।

ভয়ে এমন রফা-দফা যে শুধু মনে হত, ইস! কি দরকার ছিলো ওসব ছাই-পাশ দেখার। প্রতিদিন ওমনভাবে ভয় পেতাম। কিন্তু প্রতিদিন ঠিকই টিভি দেখতে যেতাম। এখন মনে হয়, কি গাধাটাই না ছিলাম। তবে এটাও সত্যি, মানুষ ১ দিন কিংবা ২ দিনের নয়, গাধা সারা জীবনের জন্যই। জীবনের একেক সময়ে একেক জনের কাছে গাধা হয়ে দিন গুজরান করতে হয়। গাধা যেমন সারাটা জীবন ভার বহন করেও গাধামির বেশি কিছু হতে পারেনা বিষয়টি অনেকটা ঠিক সেরকম। প্রতি বছর ক্লাসে ফার্স্ট না হলে কিংবা দাম বেশি দিয়ে পঁচা মাছ কিনলে উচ্চতর লেভেলের গাধা হিসেবে পরিচিতি লাভ হয়, সেও মন্দ নয়।
-‘তুই একটা আস্ত গাধা’।
নিজের বাপের কাছে এই মহান বাণী শুনেনি, বুকে হাত দিয়ে কেউ বলতে পারবে? জানি, পারবেন না। তবে গালি দেয়ার সময় বাপদের এই কথাটা একদম মনে থাকেনা যে, গাধার পেটেই কেবল গাধার জন্ম হয়।

তবে গাধার চেয়ে কুকুর ভালো। কুকুরের সাথে মানুষের সম্পর্ক আদি কালের। অসহায় যুগের মানুষের উপর হিংস্র কোন পশুর আক্রমন ঠেকিয়ে দিয়েছে কুকুর। সভ্যতার হাইওয়ে-তে উঠার যে ইতিহাস তারও পাতায় পাতায় কুকুরের নাম লেখা থাকবে। প্রভূ-ভক্তির মাপকাঠিতে কুকুরের তুলনা শুধু কুকুরের সাথেই করা যায়। আর সেকারনেই কিনা, মানুষও কুকুরকে কম কিছু দেয়নি। ভারত ভ্রমনের সময় দেখার অভিজ্ঞতায় বলছি। দিল্লীতে কিংবা সারা ভারতে সবচেয়ে স্বাধীন ও সুখীর তালিকায় সম্ভবত কুকুরের নাম সবার উপরেই থাকবে। রাস্তায়, উঠোনে, মার্কেটে কিংবা পার্কে কোথায় কুকুর নেই। হাইকোর্টের বিচারে কুকুর এমন স্বাধীনতা লাভ করেছে। কুকুর হত্যা কিংবা সরিয়ে নেওয়া কোনটারই অপশন রাখেনি মহামান্য হাইকোর্ট। আমাদের ঢাকাতেও তাঁর ব্যতিক্রম নয়। কুকুর আর কুকুর। তবে এটাও মনে রাখতে হবে, ঢাকার রাজপথে, অলিতে-গলিতে হাজারো পথশিশু  বেওয়ারিশ কুকুরের মতই থাকে। যেখানে রাত সেখানে কাত নামক অনিন্দ্য সুন্দর সিস্টেমে ওদের বেশ চলে যাচ্ছে। দিনের পর দিন। রাতের ফুটপাথে, তেজগাঁও রেলস্টেশনে, কড়াইল-আগারগাঁও বস্তিতে গেলে গুলশান-বনানীকে সত্যি সত্যি আপনার আম্রিকা মনে হতে পারে।

অথচ উন্নত বিশ্বে কুকুরও পথশিশুদের চেয়ে বেশি সমাদরে বেড়ে ওঠে। সেখানে সে পরিবারের একজন পূর্ন সদস্য। সেখানে কুকুর এখনও আদিম কালের সেই সময়ের মতই নিঃসঙ্গ মানুষের সাথী। মুদির দোকানে মানুষের পাশাপাশি কুকুরের খাবারও সাজানো থাকে। কি সুন্দর গণতান্ত্রিক ব্যবস্থা। কেউ তাক ভুল করে কুকুরের খাবার খেয়ে ফেললে কি ব্যবস্থা তা অবশ্য জানিনা। তবে রাস্তায় হাগু করা কুকুরের মল টিস্যুতে মুড়ে হাতে নিয়ে ঘুরতে দেখেছি তার মালকিনকে। সে দেখার মত দৃশ্য বটে। এক টিকেট কেটে দুই সিনেমার মনোহর দৃশ্যের চেয়ে কম মজাদার নয়!! অনেক কিছুর সাথে মানুষের ভিতরে একটা পশুও বাস করে। সেই পশুটার সাথে হায়েনার তুলনা হতে পারে। হ্রদপিন্ড ফুটো করে, মাথার শক্ত খুলি ভেদ করে, সেই হায়েনাটা বাইরে আসতে চায়। মানুষ ও ভিতরের পশুর মধ্যে সেই লড়াই আদিকালের। কখনও হায়েনা জিতে যায়, কখনওবা মানুষ। মনের পশুর কাছে হেরে যাওয়া মানুষ আসল পশুর চেয়েও বেশি ভয়ংকর হয়। তখন পশুরাও সেই ভয়ংকর মানুষকে ভয় পায়।

ওদিকে কখনও কখনও মানুষকে পশুর সাথে তুলনা করলে তাঁরা বেশ খুশি হয়।
যদি বলেন, “আপনি তো একটা বাঘের বাচ্চা”।
আহা এতে তিনি কি খুশি।
কিন্তু পিঠ চাপড়িয়ে যদি বলেন, ‘তুই একটা কুত্তার বাচ্চা’।
তাইলে হইছে! সুযোগ পাইলে যে ওইসব কথা বলে তাঁর ১৪-গোষ্ঠি নির্বংশ করে দিবে।

এবার একটা সিরিয়াস কথা বলি। খবরে প্রকাশ, করোনার মত এমন মহামারিতেও চুরির ঘটনা বেড়ে গেছে। মানুষ করোনার সাথে লড়াইয়ে প্রায় জিতে গেলেও মনের পশুর সাথে একদম পারছেনা। শুধু চুরি নয়, ধর্ষণ ও হত্যার মত পাশবিকতার গ্রাফও উর্ধ্বমূখী। কি ভয়ংকর উপায়ে একজন আরেকজন মানুষকে হত্যা করছে। কী বিভৎস উপায়ে একজন কিশোরীকে তের জন মিলে ধর্ষণ করছে। এরপরও সেই কিশোরী ও তার গার্ডিয়ান নিজেদের ভাগ্যবান ভাবতে পারে যদি ধর্ষণ করার পর হত্যা না করে। কুকুর কামড়ালে ভ্যাকসিনে সেরে যায়। কিন্তু সমাজের কিছু কুত্তার কর্মকান্ডের চিকিৎসা নেই বললেই চলে। সম্ভবত সে কারনেই বলা হয়, কুত্তার চেয়ে কুকুর ভালো।

অনেকে আমাকে লিখতে উৎসাহ দেন। তাদের মধ্যে অনেক গুনীজন আছেন। তাদের মতে, আমি একজন ভালো লেখক। আমার হাতের লেখা তেমন ভালো ছিলোনা কখনই। তবে হ্যাঁ, আমি তাদের কথা অস্বীকার করিনা। মনে পড়ে, ক্লাস ওয়ান থেকেই আমি লেখক। তখন থেকে আমি লিখতে শিখেছি। সে অর্থে আমি লেখক। তবে ব-কলম লেখক। সেটাও কম কী! আমার এক মামা সাব-রেজিস্ট্রি অফিসে চাকরি করতেন। ছোট বেলায় মামার অফিসে অনেক যেতাম। সেখানে প্রথম দেখি, দলিল-লেখকরা কত দ্রুত লিখতে পারেন। সেসময় মনে হত, ইস ওদের মত এরকম দ্রুত গতির লেখক হতে পারতাম যদি!

বাঘের গল্পটা সাব-রেজিস্ট্রি অফিসে ঢুকে পড়েছিলো। সেটা শেষ করি। নওগাঁয় আমাদের একটা বাঘ আছে। বেশ শান্তশিষ্ট এবং লেজ বিশিষ্ট। এই বাঘটা অন্য রকমের। বনেরও নয়, মনেরও নয়। তবুও মনের মতই। চুপচাপ দাঁড়িয়ে থাকে আর চারদিকে খেয়াল রাখে। গতকাল তাঁর খুব কাছাকাছি গেছিলাম। সাথে একটা যুগল ছবি তুলেছি। সেটা জানান দেয়ার জন্য এত ভূমিকার অবতারনা করেছি।

মানে মানে বুঝে নেন! আমি কি বাঁচাল? আমি কী অত বকবক করি।

 

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here

Reviews

Popular Articles