Al-Nuayman ibn Amr al-Najjari: প্রাংকস্টার এক সাহাবীর গল্প

Oddcaster's Random

নুয়াইমান ইবন আমর, প্রাংকস্টার এক সাহাবী

আজ যার কথা বলবো নুয়াইমান ইবন আমর তার নাম। সাহাবীদের মধ্যে বেশ জনপ্রিয় সাহাবী ছিলেন তিনি। জন্মদিনের কোন সঠিক তথ্য না পাওয়া গেলেও প্রতিথযশা এই সাহাবী ৬৩২ খ্রিষ্টাব্দে ইন্তেকাল করেন। মদীনার বনু নাজ্জার গোত্রের সন্তান এবং ঐ শহরের প্রথম দিককার ইসলাম গ্রহণকারী দের একজন। এছাড়াও তিনি ছিলেন বদর, উহুদ ও খন্দকের যুদ্ধের একজন গাজী। এতদ গুণাবলি স্বত্বেও একজন মজার মানুষ এবং প্রাংকস্টার হিসেবেই তিনি ইসলামের ইতিহাসে বেশি সমাদৃত।

তিনি আবদুর রহমান ইবনে আউফের বোন এবং উকবা ইবনে মুয়াতের কন্যা উম্মুল কুলসুমের সাথে বিবাহবন্ধনে আবদ্ধ হবার মাধ্যমে কুরাইশদের সাথে সম্পর্ক স্থাপন করেন। তিনি (উম্মে কুলসুম) তার পূর্বস্বামী আয-জাবের ইবনে আল-আওল এর কঠোরতা এবং তীব্রতার কারণে তার স্বামী থেকে তালাক নেন।

মজার মানুষ নুয়াইমান ইবন আমর

তার কৌতুকের/প্রাংকের জন্য পরিচিত হওয়া ছাড়াও, নুয়াইমান পানাসক্ত ছিলেন বলে জানা যায়। মাদকদ্রব্য পানীয়ের বিরুদ্ধে ইসলামের শাসন সত্ত্বেও নুয়াইমান তার অভ্যাস ত্যাগ করার জন্য লড়াই করেছিলেন। পান করার জন্য দুবার চাবুকও খেয়েছিলেন। উমর (রাঃ) তাকে খুব একটা দেখতে পারতেন না। দ্বিতীয় চাবুকের পর, উমর (রা) নুয়াইমান এর এহেন আচরণে ভীষণ ক্ষুব্ধ হয়ে বলেই ফেললেন ” তোমার উপর আল্লাহর লানত (অভিশাপ)”

রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বললেন, “না, না (লানত) করো না, নিশ্চয় তিনি আল্লাহ্ ও তাঁর রসূলকে ভালোবাসেন। এহেন কবিরাহ গুনাহ এইভাবে কাউকে সমাজচ্যুত করে না এবং আল্লাহর রহমত বিশ্বাসীদের জন্যেই “

রাসুল(স) এর নিকট নুয়াইমান ইবন আমর

নবীজি আন নুয়াইমানের ব্যাপারে যেমন দৃঢ় ছিলেন তেমনি তার বদলে যাবার ব্যপারেও আশাবাদী ছিলেন, যেহেতু বদরের যুদ্ধের একজন গাজী ছিলেন তিনি। যেহেতু তিনি তার পাপমূলক কাজ গোপন করার চেষ্টা রাখতেন না, তাই তার পক্ষে তার অপরাধ স্বীকার করা এবং অনুতাপ করা এবং আল্লাহর কাছে ক্ষমা চাওয়া সহজ ছিল। মোদ্দাকথা তিনি সদাই নবীজির স্নেহধন্য ছিলেন।

কিছু ঘটনা শেয়ার করা যাকঃ

১) একবার আন নুয়াইমান স্বাক এ গিয়েছিলেন এবং কিছু সুস্বাদু ও মজাদার খাবার বিক্রিত হতে দেখেন। এইখাবার দেখেই তার নবীজির কথা মনে হলো। “যে উনি তো খেতে পারতেন এই খাবারগুলো।” তিনি পরে দাম দেবেন বলে কাফেলার মালিক থেকে খাবার নিয়ে রাসূল (সা) কে দিয়ে বললেন, “ইয়া রাসূলুল্লাহ, এই ফল আপনার জন্য হাদিয়া।” অধিকাংশ সময় অর্ধাহারে অনাহারে থাকা রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম খাবার দেখে খুশি হলেন এবং সপরিবারে খেলেন। কাফেলার মালিক নুয়াইমানের কাছে টাকা চাইলে তিনি রাসূল (সা) কে দেখিয়ে বলেন, “আমি খাবার খাইনি, রাসূল (সা) ও তার পরিবার তা খেয়েছেন। উনার কাছ থেকে দাম নিন।” ব্যবসায়ী রাসূল (সা) এর কাছে গিয়ে টাকা দাবি করলে রাসূল (সা) বুঝলেন বিষয়টা, নুয়াইমানকে ডাকলেন আর জিজ্ঞাস করলেন, “নুয়াইমান, তুমি কি খাবার আমাকে হাদিয়া দাওনি?” তিনি বললেন, “ইয়া রাসূলুল্লাহ, এই খাবার টা আমি খেতে চেয়েছিলাম। পরে ভাবলাম আপনাকে প্রথমে খাওয়াই, আপনি খেতে পছন্দ করবেন। তাই আপনাকে দিয়েছিলাম। কিন্তু আমার কাছে বিক্রেতাদের দেবার মতো কোন দিরহাম নেই। সুতরাং, হে আল্লাহর রসূল দয়া করে মূল্য পরিশোধ করুন!!”

রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ও উপস্থিত সাহাবীগণ একচোট হাসলেন। যদিও হাসির মূল্য তাকেই পরিশোধ করতে হয়েছিলো খাবারের দাম দিয়ে।  এই ঘটনাটি থেকে দুটি উপকার এসেছে। নবী ও তার পরিবার খাদ্য উপভোগ করেছিলেন এবং মুসলিমদের একটি হাসির খোরাক ছিল এই ঘটনাটা।

 

২) আবু বকর এবং কয়েকজন সঙ্গী বসরার দিকে বাণিজ্য কাফেলা নিয়ে যান। সফরের বিভিন্ন ব্যক্তিদের নির্দিষ্ট দায়িত্ব দেওয়া হয়েছিল। সুয়াইবিত ইবন হার্মালাহ ছিলেন খাদ্য এবং রীতিবিধানের দ্বায়িত্বে। নুয়াইমানরা একদল ছিলেন এবং তিনি ক্ষুধার্ত হয়ে যাচ্ছিলেন এবং কিছু খাবারের জন্য সুয়াইবিতকে বার বার রিকোয়েস্ট করছিলেন। সুয়াইবিত ও ওদিকে সমানে রিকোয়েস্ট রিজেক্ট করতেসিলেন। আননুয়াইমান বললেন, ” জানেন আমি আমি আপনের লগে কি করবার পারি?” এরকম হুমকি ধামকি দিয়েও সুবিধা করতে পারলেন না আননুয়াইমান। আননুয়াইমান তখন আরবের একটি দলকে স্বাকে গিয়ে পেয়ে গেলে তার মাথায় দুষ্ট বুদ্ধি খ্যালা করে গেলো। ভালো মানুষটির মতো তাদের কাছে গিয়ে বললেন: “আপনারা কি এক শক্তিশালী ও বলিষ্ঠ দাস কিনতে চান, যাকে আমি আপনাদের কাছে বিক্রি করতে পারি?”

আরব কাফেলা হাঁ হাঁ করে উঠলেন। জবাবে আননুয়াইমান বললেন “দাস কিন্তু খুব মুখরা আর খুব মুক্তপ্রাণ ভাব দেখাবে, বলে বসবে, ‘আমি আযাদ’ কিন্তু তার কথা আবার শুইনেন না যেন” একজন কিনতে রাজি হলেন ১০ দিরহামে। নুয়াইমান সুয়াইবিতকে দেখিয়ে দিলেন। তো ক্রেতা তো তার গোলাম সুয়াইবিতকে(রা) নিতে গেলে শুনে গোলাম নাকি আযাদ দাবি করছে নিজেকে। ক্রেতা শক্ত করে ধরলেন সুয়াইবিতকে(রা) যেন কেনা গোলাম না ছুটে যায়। তবু ওই সাহাবী তারস্বরে বলেই যাচ্ছিলেন ‘আমি গোলাম না আমি আজাদ! আমি গোলাম না আমি আজাদ!’ পুরা সময়টা আননুয়াইমান একটুও হাসেন নাই। পুরোদস্তুর ঝানু অভিনেতার মত অমায়িক একটা ভাব করে রেখেছিলেন। এই কান্ড দেখে তো কাফেলার সাহাবীরা হাসতে হাসতে শেষ! পরে অবশ্য আবু বকরকে খবুর দেয়া হলে উনি ছুটতে ছুটতে এসে পুরা ঘটনা টা বুঝালে তারপর বুঝতে পেরেছিল ক্রেতা, আর টাকাও ফেরত পেয়েছিল।

এই কাফেলা মদিনায় ফিরে এসে যখন রাসূল (সা) কে বিস্তারিত ঘটনা জানালো তখন রাসূল (সা) নিজেও সবার সাথে হাসলেন। এই ঘটনা বর্ণনাকারী সাহাবী উম্মে সালামা বলেছিলেন, এই ঘটনা প্রায়ই মনে করে রাসূল (সা) সহ সাহাবীরা বছরখানেক হেসেছিলেন।

 

৩) এক ব্যক্তি নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর কাছে দূতিয়ালি করতে আসলে তাঁর উট মসজিদের দরজার সাথে বেঁধে দাঁড়ালেন। এরকম ত্যালত্যালা উট দেখে তো সাহাবীদের জ্বিভে জল আসার জোগাড় তাদের ক্ষুধা ক্রমবর্ধমান হারে বাড়তে লাগলো। তো সেই ক্ষুধা নিবারণের জন্য যোগ্য লোক কে তা তারা জানতেন। তারা নুয়াইমানকে উস্কে দিলেন, ” কি নুয়াইমান হবে নাকি ব্রো?”

তারা জানতেন নুইয়ামান মজার কোনো কান্ড করবেন। তো নুয়াইমান উটকে জবাই করে রেঁধে সবাইকে খাওয়ানো শুরু করলেন। বেচারা খ্রিষ্টা ধর্মানুসারী আরব দেখাসাক্ষাত শেষে সাহাবীদের উটের বার্বিকিউ গ্রিল করা খাওয়া দেখে বুঝছেন যে কাম সারা। “ওরে আমার উট, ওরে আমার উট” বলে বিলাপ করতে লাগতো সে।

চিৎকার চেচামেচি শুনে নবিজী বের হয়ে আসলেন। উটের মালিক রাসূল (সা) এর কাছে বিচার দিলে রাসূল (সা) নুয়াইমানকে ডাকলেন। কিন্তু ওদিকে অপরাধী নুয়াইমান তো ভো দৌড় দিয়ে একেবারে খেজুরের বাগানে গিয়ে পলানটিস দিলেন। কেউ আর খুঁজে পায় না তাকে। শেষে রাসূল (সা) নিজে খুঁজতে বের হয়ে পেলেন যেখানে নুয়াইমান বাগানে ধুলোর মধ্যে লুকিয়ে ছিলেন। রাসূল (সা) নিজের হাত দিয়ে নুয়াইমানের মুখের ধুলা পরিষ্কার করে দিচ্ছিলেন আর নিজেও হাসছিলেন এই কান্ড দেখে। পরে অবশ্য উটের মূল্য দেয়া হয়েছিল এবং উটের মালিক ও মেগাফিস্টে অংশগ্রহণ করেছিলো।

 

৪) আরেকটা কাহিনী, তখন উসমান (রা) এর খিলাফতের সময়। এক অন্ধ লোক (নাম মাখরামা) পেশাব করার জায়গা জিজ্ঞাস করেছিলেন নুয়াইমানের কাছে। নুয়াইমান তাকে নিয়ে গেলেন এক পাবলিক প্লেইসে। ঐ লোক তো পেশাব করছেন। লোকেরা তাকে পেশাব করতে দেখে হাসছিল। পরে তাকে বলা হল “তোমার সাথে এই কান্ড নুয়াইমান করেছে।” অন্ধ লোক বলে, “কোথায় নুয়াইমান? কেউ আমাকে তার কাছে নিয়ে চল। তাকে পেলে আমার লাঠি দিয়া ওর মাথায় বাইড়ামু” তো নুয়াইমান আবারো তার কাছে এসে কন্ঠ পরিবর্তন করে জিজ্ঞাস করলেন, “তুমি না নুয়াইমানকে খুঁজছো? চলো আমার সাথে আমি নিয়ে যাই নুয়াইমানের কাছে।” অন্ধ লোককে মসজিদে নিয়ে একজনের কাছে ছেড়ে দিয়ে বললেন এই যে নুয়াইমান। অন্ধ লোক তো ঐ লোকের মাথায় কসে দিলেন একটা বাড়ি। আহত লোকটি বললেন, “তুমি এইডা একটা কাম করলা?” অন্ধ বললো, তুমি নুয়াইমান আমাকে রাস্তায় সবার সামনে আমাকে পেশাব করিয়েছো। মার খাওয়া সেই লোক বললো আরে আমি নুয়াইমান না, আমি আমিরুল মুমিনীন উসমান। শুনে অন্ধ লোক ভয়ও পেলেন আবার নুয়াইমানের উপর আরো ক্ষেপে গেলেন। উসমান রাদিয়াল্লাহু আনহু নিজেও পরে হাসছিলেন। তিনি বললেন, “নুয়াইমানকে ছেড়ে দাও। আল্লাহর রাসূল (সা) তার মজা সহ্য করেছেন, আমিও করবো।”

আবার এই সাহাবীই মুয়াবিয়ার সময়ে মুসলিমদের মধ্যকার ফিতনা ও অসন্তোষ এ কষ্ট পাচ্ছিলেন এবং তার জীবনের ঐ শেষ কবছরগুলোতে তাকে কেউই কখনো হাসতে দেখেনি।

আমাদের মতামতঃ

যাইহোক, নবী (সা) স্বীকৃত ছিলেন নুয়াইমান (রা)। তার একটি অনন্য চরিত্র ছিল যেটা অন্য প্রধান সাহাবাদের মত নয়। আলাদা হওয়ার জন্য তাকে দোষী করার পরিবর্তে, নবী (সাঃ) তার উত্তম উদ্দেশ্যকে স্বীকৃতি দিয়েছিলেন।

আল্লাহ সুবহানাহু ওয়া তায়ালার রহমত বর্ষিত হোক নুয়াইমান (রা) এবং নবী মুহাম্মদ (সা) এর অন্যান্য সহযোগীদের উপর। আমীন।

 

বিদ্রঃ যারা কাহিনীগুলার অথেন্টিসিটি নিয়ে প্রশ্ন তুলবেন তারা এই লিঙ্কটি দেখে নিতে পারেন!

 

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here

Reviews

Popular Articles