তিথি ভাবির দিকে তাকিয়ে আমি বললাম “তোমাকে আজ সত্যিই পরির মতোই লাগছিলো” হাবিব ভাই দেখলাম মুখ কালো করে অন্য দিকে ঘুরিয়ে ফেললেন। সেই মুখে দুনিয়ার দ্বন্দ্ব, অসন্তুষ্টি আর ঘৃনা। তিথি ভাবি ছোট্ট করে জিহবায় কামড় দিয়ে ইশারাতে চুপ করতে বললেন। তারপর ইশারা দিয়ে চলে যেতে বললো। আমিও ফাক বুঝে এই “যাই আসি” বলে বলে চলে এলাম বাসায়।
এমন না যে আজই প্রথম আমি তিথি ভাবির প্রশংসা করলাম । আগেও তো করেছি,হাবীব ভাইয়ের সামনেই।কিন্তু বুঝতে পারলাম না এতোটা প্রতিক্রিয়া কেন হলো…তবে সত্যি বলতে তিথি ভাবির ইশারাতে যে কি একটা মাদকতা ছিলো; সেভাবে ইশারায় কেউ কখনো আমাকে চোখে চোখে কথা বলেনি…
সন্ধ্যার পর পরই তাদের বাসায় ফুচকি দিয়ে দেখলাম তিথি ভাবি একা বসে আছে বারান্দায়।
-আচ্ছা তোমাকে প্রশংসা করায় ভাই আজকে এতো কালো মুখ করলো কেন? তুমিই বা ইশারাতে এমন করলে কেন?
তিথি ভাবি অনেকটা সময় চুপ থেকে বললো “জানিস না । তোর ভাইয়ের দুনিয়ার সন্দেহ। তোকেও নিয়েও…” হঠাৎ করে এই “সন্দেহ” শব্দটা আমার সমস্ত অস্তিত্ব জুড়ে একটা ঝড় তৈরী করলো। মনে হলো বুকের কোথাও অনর্গল একটা ছন্দ তৈরী হয়েছে। সন্দেহ কি মানুষ এমনিই করে?
-আমাকে নিয়ে সন্দেহ করার কারন কি?
-কি জানি? বলে বাড়ি আলার ছেলে শুধু আসে…আড্ডা দেয়…তুমিও হাসি মুখে এতো কি কথা?
-আমি না হয় আসলাম বারবার…কিন্তু তোমাকে তো আর এমনি এমনি সন্দেহ…
-মানে কি বলতে চাস? হাবীব তোকে ছোট ভাই মনে করে…কিন্তু ।। …
-উনি আমার ভাইনা ভাবি। এই আর কি…ভাড়াটে…তুমি আমার সত্যিকারের ভাবিতো নও…আর হলেই বা কি? সেদিন তোমাকে “নষ্ট নীড়” বোঝালাম…
তিথি ভাবি পায়ের থেকে স্যান্ডেল হাতে নিয়ে বললো –“দেবো?” আমি হেসে বললাম “তাতে আমারো সন্দেহ বেড়ে যাবে…”
পরের দিন সকালে আরিফকে পেলাম। বললাম “আচ্ছা ধর তুই বিয়ে করেছিস। বিয়ে তো করবিই। এখন তোর বউয়ের উপর তোর কখন সন্দেহ আসতে পারে?” আরিফ রেগে বললো “সন্দেহ করব কেন? আমি সন্দেহর লোক নাকি? …”
- না না। মানুষ সন্দেহ করেনা? স্বামী স্ত্রীর সম্পর্ক ভেস্তে যায় কি করে? সন্দেহ…
- হুম…শোন মেয়ে গুলোর তো ঠিক নাই। দুর্বল হয়ে যায় অনেক সময়। স্বামীরা বোঝে এসব। সন্দেহ…
সে দিন ক্লাসে প্রচুর অপমা্নিত হতে হলো আমাকে। এক মনে বাইরের আকাশের দিকে তাকিয়ে ছিলাম। ফিজিক্স স্যার তাকিয়ে বললেন “এই যে নীল শার্ট অমনোযোগী আকাশগামী গাধা… Theory of relativity মানে কি বোঝ বলতো?”
আমি অনেকক্ষন ভেবে বললাম “স্যার রিলেটিভ বা আত্বীয়দের মাঝে একটা সম্পর্ক থাকে…” স্যার গলা বাড়িয়ে বললেন ‘গেট আউট। সোজা বের হয়ে যাও…এতো দেখি সত্যি সত্যি গাধা,… ২৫ বছরের শিক্ষকতায় প্রথম একটা সত্যিকারের গাধা পেলাম…”
ক্লাস শেষে রিমাকে বললাম “তুইতো বিবাহিত ।।তোর স্বামী তোকে সন্দেহ করে ? কেন করে?”
রিমা বললো “পুরুষ মানুষ সন্দেহ ছাড়া হয়নাকি রে? তবে সে ভালো মানুষ সহজে ঝামেলা করেনা। তবে একবার বুঝেছিস…আসলে আমারো ছেলেটার প্রতি কেমন মায়া পরে গেছিলো…সে টের পেয়ে গেলো…”
পরের তিনদিনও আমাকে ফিজিক্স স্যার ক্লাস থেকে বের করে দিলো। প্রতি বার বললো “এতো দেখি সত্যি সত্যি গাধা।।২৫ বছরের মাঝে এই প্রথম পেলাম সত্যিকারের গাধা…” আমি আরো ৬ জন বিবাহিত নারী-পুরুষের কাছ থেকে সন্দেহ কেনো হয় জানলাম।কয়েকরাত ঘুম এলোনা ঠিক মতো।
তিথি ভাবিকে একলা একলা একদিন পেলাম। হুট করে বাসায় ঢুকে পড়লাম। “ভাবি বলোনা, কেন তোমাকে আমাকে পেচিয়ে সন্দেহ করে? তোমার নিশ্চয় আমার প্রতি দুর্বলতা আছে” ভাবি আবার পায়ের স্যান্ডেল হাতে নিতেই , চলে এলাম পথে…
পরীক্ষার আগে আগে তিথি ভাবির বাসায় ঢুকতে গেলাম। হাবীব ভাই কড়া গলায় বললেন “দোয়া চাইতে এসেছো, বাইরেই থাকো…এই তিথি অপুকে দুয়া করে দেও…”তিথি ভাবি ইশারায় আবারো আমাকে চলে যেতে বললো। এবার আরো কোমল ইশারার ভাষা। আর তাতেই আমার কাজ হলো। স্যান্ডেল হোক আর কোমল ইশারা । একটা হলেই আমার হয়।
বাড়ি ফিরে দরজা জানালা বন্ধ করে পড়া শুরু করলাম। পরীক্ষা দিয়েই চলে গেলাম বাগেরহাট। একমাস আছে রেজাল্টের। খালার বাসায় খালাতো ভাই বোন আর বন্ধু বান্ধব নিয়ে আড্ডা দেই। অনেক রাতে বন্ধুরা প্রেম বিষয়ক গল্প আনে। তারা তাদের জীবনের হাল্কা সব রোমান্সের গল্প তোলে । আমি বলি সন্দেহর গল্প। পৃথিবীর সবচেয়ে সুন্দর মেয়েটির স্বামী আমাকে সন্দেহ করে তার স্ত্রীকে জড়িয়ে। আমার জীবনের রোমান্স এখানেই। অনেকটা পৌরুষময় স্বার্থকতাও এখানে। এই সন্দেহে আমার রাত আলাদা রকমের শিহরনে কাটে।
সেবার এইচ. এস. সি. তে “বাগবাতি কলেজ” থেকে কেউ ফেল করেনি। দুইজন স্টার পেয়েছিলো। আমি ছিলাম তার একজন। ফিজিক্স স্যার আমাকে জড়িয়ে ধরে চিৎকার করে বললেন “তুই দেখি আসলেও গাধা। এতো যে ভালো ছাত্র বুঝিনিতো। কি আশ্চর্য” আমার মুখে অনেক হাসি লেগে থাকার কথা ছিলো। কিন্তু খুব একটা হাসতে পারছিলামনা। বাবা জানিয়ে দিয়েছিলো পাড়ার কয়জনের বাসায় মিষ্টি পাঠাতে হবে। আমি গুণে গুণে মিষ্টি দিয়ে আসলাম। বাসায় ফেরার পর বাবা জড়িয়ে ধরে কাদলো। আমার না কান্না আসলো , না হাসি। মা বললো “মার্ক পেলে দেখবি কত ভালো করেছিস। মন খারাপ কেন?”
আমার মন খারাপ কেন? আমার মন খারাপ কেন? আমার মন খারাপ কেন?
আমি বইয়ের ফাকে লুকিয়ে রাখা চিঠিটা আবার পড়ি।
তিথি ভাবি লিখে গেছেন “হাবীবকে যতটা গাধা ভেবেছিলাম, তত টা নয়। অন্তত একটা সন্দেহ সে জায়গা মতোই করেছিলো। ভাগ্যিস করেছিলো নইলে কি একটা ঝামেলা হতো বলতো। নষ্টনীড়ে বাস করা খুব কঠিন এখন তার চেয়ে ঢেড় ভালো নষ্টনীড়কে মনে নিয়ে চলে গেলাম। কোন ঠিকানা পাবিনা। কেউ জানেনা কোথায় যাচ্ছি। বড় হোস আর আমার চেয়েও সুন্দরী কাউকে বিয়ে করিস-তোর তিথি ভাবি।”